যতীন সরকার
প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও লেখক
'জাতি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করে নাই' -
সীমাহীন স্পর্ধায় ভরা এমন একটি অমার্জনীয় বাক্য যখন রাজধানীর দেয়ালে উৎকীর্ণ দেখা যায় ধর্মধ্বব্জী দখলদারদের হাত থেকে রক্তমূল্যে স্বাধীনতা অর্জনের আঠার বছর পরে, তখন বিস্ময়ে মূক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। সেই বিস্ময় তীব্র হতাশায় আর ক্ষোভে পরিণত হয় যখন কোনো অকুতোভয় মুক্তিসংগ্রামী এমন স্পর্ধিত বাক্যের সমর্থনে মন্তব্য করেন, "১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সংগঠিত হয়নি। জাতি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করেছে বলে আজ যারা দাবি করছে তারা সজ্ঞানেই মিথ্যা এবং প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অস্থানীয় শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদেশীয় বাঙালিদের অর্থনৈতিক বৈষম্যভিত্তিক গড়ে ওঠা পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এই গণবিস্ফোরণের জন্য কোন আদর্শিক ভিত্তি ছিলনা। সুতরাং দেয়ালে যে প্রচারপত্র দেখা যাচ্ছে, তা একেবারেই অমূলক নয়।"
[২১ সেপ্টেম্বরের 'খবরের কাগজ'-এ মেজর জলিলের সাক্ষাৎকার]
একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখ দিয়ে যখন এমন কথা বেরিয়ে আসে, তখন বুঝতে হবে যে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও জাতীয় মুক্তি সম্পর্কে তাঁর কোন স্পষ্ট বোধ নেই এবং বাঙালির সংস্কৃতি ও অভীপ্সা সম্পর্কে নেই সামান্য ধারণাও।
বাঙালির সংস্কৃতি চিরকালই অসাম্প্রদায়িক। কায়েমী স্বার্থ যখনই একে সাম্প্রদায়িকতার পাঁকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছে, তখনই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের শৃঙ্খলে বাঙালির সংস্কৃতিকে বেঁধে ফেলাই ছিল কায়েমি স্বার্থের সবচেয়ে বড় চক্রান্ত। এ চক্রান্ত কিছুদিনের জন্য হলেও সফল হয়েছিল বটে, কিন্তু মাত্র চব্বিশ বছরের মধ্যেই চক্রান্তের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি-চেতনাই যে বাঙালিকে এই শৃঙখল ছেঁড়ার শক্তি যুগিয়েছে - এ সত্যকে যাঁরা অস্বীকার করতে চান তাঁরা নিতান্তই দিবান্ধ।
বাঙালি অবশ্যই ধর্মবিরোধী নয়, এ জাতি বরং ধর্মের মর্মকে তার চেতনায় অপরিত্যাজ্যরূপে ধারণ করে। কিন্তু ধর্মের মর্মকে উপেক্ষা করে তার খোলস নিয়ে যারা মাতামাতি করে তাদের প্রতি বাঙালি চিরকাল সীমাহীন ঘৃণা পোষণ করে এসেছে। 'মরম না জানে ধরম বাখানে এমন আছয়ে যারা, কাজ নাই সখি তাদের কথায় বাহিরে রহুন তারা।' - মধ্যযুগের বাঙালি কবি চণ্ডীদাসের এ কথাই সব বাঙালির প্রাণের কথা। এই প্রাণের কথাই আবহমান বাংলা ও বাঙালির শিল্পে-সাহিত্যে- সংস্কৃতিতে নানা ভাষায় ও নানা ভঙ্গিতে রূপ পেয়েছে। বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিক আচারকে বাঙালি অবশ্যই গ্রহণ করেছে, এসব বিশ্বাস ও আচারের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়েও বাঙালি বিভক্ত হয়েছে নিশ্চয়; কিন্তু কোন সাম্প্রদায়িক বিভক্তিই তার সংস্কৃতিকে বিভেদ ও বিদ্বেষের চোরাবালিতে আটকাতে পারেনি। সম্প্রদায়ে বিভক্ত থেকেও বাঙালির সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পায়নি। ধর্মীয় চেতনাকে বাঙালি গভীর মমতায় লালন করেছে, কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তীব্র ঘৃণায়। তাই সংস্কৃতিচিন্তার মতো বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায়ও ধর্মনিরপেক্ষতারই ('সেকুলারিজম' অর্থে) একাধিপত্য। ধর্মীয় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ধর্মের অপ-ভাবনা গুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে সংখ্যালঘিষ্ঠ একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীই। এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই বাঙালি এ দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে ; পেছন দরজা দিয়ে ঢুকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুনভাবে পাকিস্তানি ভাবনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় যে মৌলবাদ, তারও কবর হবে এখানেই।
মুসলিম বা হিন্দু কোন ধর্মীয় মৌলবাদই বাঙালির মৌল সংস্কৃতিতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বাঙালির মৌল সংস্কৃতি মানে তার লোকসংস্কৃতি। এখনক যদি গ্রামের কোনো গানের মজলিসে কান পাতা যায়, তবে এই অসাম্প্রদায়িক মৌল সংস্কৃতির কিছু না কিছু পরিচয় পাওয়া যাবে, শোনা যাবে গায়েন তার বন্দনায় গাইছে -
পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুশ্বর,
একদিকে উদয় গো ভানু চৌদিকে পশর।
উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত,
যেখানে রাইখ্যাছে আলী মাল্লামের পাথর।
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা হেন স্থান,
উদ্দিশে জানায় গো সালাম মুমিন মুসলমান।
দক্ষিণে বন্দনা করি ক্ষীর নদী সাগর,
যে দইর্যায় বাণিজ্য করছে চান্দ সদাগর।
যেসব বস্তুর মিশ্রিত রূপকে এখানে বন্দনীয় রূপে গ্রহণ করা হয়েছে, হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীরা তার কোনটিতেই তুষ্ট হবেন না। কিন্তু বাঙালির মূল ঐতিহ্য এটিই। তার সমস্ত সংস্কৃতিই এ ঐতিহ্যের উপাদান দিয়ে গড়া। তাই 'মুসলমান' আলাওল, সৈয়দ মুর্তজা, বা নাসির মামুদ রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে পদাবলী রচনা করে কিংবা 'হিন্দু' রাধাচরণ গোপ 'ইমামের জঙ্গ' বা শরৎনাথ ও মনমোহন দত্ত ইসলামী সঙ্গীত রচনা করে প্রকৃত বাঙালি হয়েছেন। এই বাঙালি সমাজের কবিই হিন্দু-মুসলমানের ভেদ-বিভেদের সম্পর্কে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে প্রশ্ন করতে পারেন - সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীলোকের হয় কি বিধান? বামুন চিনি পৈতায় প্রমাণ, বামনী চিনি কিসে রে?' এমনকি ঈশ্বর বা আল্লাকে উদ্দেশ করেও সাফ কথা জানিয়ে দেন। 'তোমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজিদে / তোমার ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই / রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশীদে। '
বাঙালির সাহিত্য সম্পর্কে 'বাংলার বিবেক' বলে পরিচিত আবুল ফজল তাঁর একটি উপন্যাসের একটি চরিত্রের মুখে এরকম সংলাপ বসিয়ে দিয়েছিলেন, "সাহিত্য জিনিসটা আদতে খারাপ, ভয়ানক ডেঞ্জারাস - ভালো করে পড়লে হিন্দু ছেলেমেয়ে আর খাঁটি হিন্দু থাকেনা। মুসলমান ছেলেমেয়ে আর খাঁটি মুসলমান থাকেনা। প্রায় মানুষ হয়ে ওঠে ।"
বলা নিষ্প্রয়োজন, আসলে 'খাঁটি হিন্দু' বা 'খাঁটি মুসলমানের' বিরুদ্ধে এখানে কিছু বলা হয়নি, হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্বকে যারা মনুষ্যত্বের বিপরীতে দাঁড় করায় - এ ব্যঙ্গোক্তিটি তাদেরই বিরুদ্ধে।
মানুষ বা 'প্রায় মানুষ' হতে যাদের ঘোর আপত্তি, সেই অন্ধকারের জীবগুলোই ধর্মীয় মৌলবাদের ফেরিওয়ালা সেজেছে। এরা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভীষণ ভয় পায়। জোঁক যেরকম চুনকে ভয় পায়, ঠিক সেরকম। গত ২৯ সেপ্টেম্বর' ৮৯-এর সাপ্তাহিক 'একতা' পত্রিকায় মৌলভীবাজার থেকে প্রাপ্ত এক খবরে বলা হয়েছে - "বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে দেশব্যাপী ২৫ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সপ্তাহ পালন উপলক্ষে রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের তারপাশা এলাকার একাসন্তোষ শাখা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'সাম্যবাদী' কবিতার ২৩ ও ২৪ নং ছত্র 'মসজিদ এই মন্দির এই গীর্জা এই হৃদয়, এইখানে বসে ঈসা মূসা পেল সত্যের পরিচয়' এই লাইন দুটি একটি পোস্টারে ব্যবহার করে। এ পোস্টারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী এলাকার ধর্মপ্রাণ জনসাধারণকে উস্কানোর চেষ্টা চালায়। এতে জনসাধারণ সাড়া না দেয়ায় সাম্প্রদায়িক এ গোষ্ঠী উদীচীর একাসন্তোষ শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহিদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়। প্রাণনাশের ভয়ে আব্দুল ওয়াহিদ এলাকায় যেতে পারছেন না ।'
এ খবরটি পড়ে আমি উদ্বিগ্ন হয়েছি অবশ্যই। কিন্তু সেই সঙ্গে বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তি সম্পর্কে নতুন করে প্রত্যয়ী হয়েছি। মুশকিল হয়েছে এই যে, আমাদের রাজনীতিকরা সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে মোটেই সচেতন বা অবহিত নন, এমনকি প্রগতিশীল রাজনীতিকরাও নন। আবার অন্যদিকে সাহিত্য-সংস্কৃতির কারবারি যাঁরা, তাঁদেরও অধিকাংশই নন্দনতাত্ত্বিকতার বৃত্ত ভেঙে সমাজনীতি রাজনীতির খোলা প্রান্তরে এসে দাঁড়াতে পারেন না। প্রগতিশীল রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতারই সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদীরা। রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রের এই বিচ্ছিন্নতা ঘুচানোর প্রয়োজন আজ খুব তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতা ঘুচে গেলে জনগণের সংগ্রাম এমন জোরদার হবে যে মৌলবাদ তখন বাপ বাপ ডাক ছেড়ে এ দেশ থেকে পালাবার পথ পাবে না।
['কথাপ্রকাশ' থেকে প্রকাশিত যতীন সরকারের 'আমার যেটুকু সাধ্য' বই থেকে সংকলিত। সম্ভবত প্রবন্ধটি '৯০-এর দশকের কোন বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল]
যতীন সরকার : জন্মঃ ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট, নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের একজন প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ তাঁর গভীর মননশীলতা ও মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি ময়মনসিংহ শহরের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়। পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু-দর্শন তাঁর অন্যতম বই।

Comments
Post a Comment