বিপ্লবের রণধ্বনি



হাবীব ইমন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়াব্যাপী যে চরম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল তারই প্রেক্ষিতে দেশে দেশে পুঁজিবাদ একচেটিয়া অধিকারভুক্ত হয়ে নানামুখি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ সকল ব্যবস্থা আপাত জনগণের কল্যাণমুখী হলেও বৃহত্তর স্বার্থে তা পুঁজিবাদকে সুবিধাজনক অবস্থায় ফেলবে না কখনোই। উপরন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ন্যায্য আন্দোলনকে শুধু তাই নয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ-আগ্রাসন চালিয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষা-বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশ ও উদারনৈতিকতাকে গ্রাহ্য না করে শোষক শ্রেণি এটিকে নেতিবাচক অর্থে প্রচার করে। অলৌকিকতা, আধ্যাত্মিকতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চালু রাখে ফ্যাসিবাদী-শক্তিসমূহ। এরই মধ্যে জার্মানি, ইতালিতে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সংঘটিত দুনিয়া কাঁপানো ‘অক্টোবর বিপ্লব’-র মাধ্যমে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করে। লেনিনের এই বিপ্লব শোষণমুক্ত গণমানুষের সমাজের স্বপ্নকে সুদূরপ্রসারী করে। ঔপনিবেশিকদের পদানত অঞ্চলগুলোতে গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব। একই সাথে সমাজস্থিত মানুষের জন্য গভীরভাবে ভাবিত হয়ে লেখনি ধারণ করেছেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক। এর প্রমাণ মেলে তিরিশের দশকেই। এ দলে ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি, রম্যা রঁলা, টমাস মান, আন্দ্রে মালরো, ফস্টার, স্ট্যাটি প্রমুখ। আর এদিকে ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাজ্জাদ জহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, মুনশী প্রেমচন্দ প্রমুখ নেতৃত্ব দেন।
এরকম যুগ ও সমাজ পরিবেশে ঔপনিবেশবিরোধী লেখক, বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ ‘বিপ্লবের কবি’ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম। পিতা : নিবারণ ভট্টাচার্য, মা : সুনীতি দেবী। সুকান্তের বাবা ছিলেন পণ্ডিত ও রসঙ্গ মানুষ। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে ‘কিশোর কবি’ অভিধায় অভিহিত বাংলা সাহিত্যে আসন করে নেয়া সুকান্তের জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। দারিদ্র্য এবং দুঃখকষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিস্থিতি ও ঘটনার মধ্যেই তাঁর পিতা-পিতামহ কলকাতার জীবন শুরু করেন। সুকান্ত তাঁর ভাইদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়; অন্যরা হলেন মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক ও অমিয়। সুকান্ত তাঁর বড় ভাই মনমোহন ভট্টাচার্য ও বৌদি সরযূ দেবীর সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একটি বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে, পঠন-পাঠন এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও শাস্ত্র চর্চার পরিবেশে সুকান্ত বড় হন। রবীন্দ্রকাব্য, কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি-র আধুনিক সাহিত্য পাঠ ও শ্রুতির মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যবোধের হাতেখড়ি।
সুকান্তের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি ছিলেন তার রাণী দি। সে-সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মণীন্দ্রলাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে রাণী দিই তার নাম রেখেছিলেন ‘সুকান্ত’। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই এ গল্পের পরিণতির মতোই সুকান্তের জীবনের যবনিকা ঘটে। সুকান্তের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তার এই জেঠতুতো বোন। ছোট্ট সুকান্তকে গল্প-কবিতা শুনিয়ে তাঁকে সাহিত্যের প্রথম ছোঁয়া তিনি দেন। সুকান্তকে কোলে নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাঁর মা তাকে রামায়ন-মহাভারত পড়ে শোনাতেন। ক’দিন পর আকস্মিকভাবে রাণীদি মারা গেলে সুকান্ত প্রচণ্ড আঘাত পান। এর কিছুদিন পর ১৯৩৭ সালে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মা-ও চিরবিদায় নেন। এর এক বছর পরেই সবচেয়ে বড় জ্যাঠতুতো দাদা গোপাল ভট্টাচার্য মারা যায়। একের পর এক মৃত্যুশোক যেন ১১-১২ বছরের সুকান্তকে করে তুলেছিলো হতাশাগ্রস্থ। বিষাদাচ্ছন্ন করে তোলে তাঁকে। নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে ওঠে। কবিতাই ছিল তাঁর একাকীত্বের সঙ্গী। কিশোর সুকান্ত হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেল। কৈশোরেই তিনি হয়ে গেলেন কৈশোরোত্তীর্ণ। অন্তর্মুখী মন নিয়ে সুকান্ত রচনা করেন একের পর এক কবিতা, ছড়া।
সুকান্ত সমগ্র-তে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুণাচল বসুকে লেখা। অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিতেন। সুকান্তের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে।
শৈশব কাটিয়েছেন বাগবাজারের তাদের নিবেদিতা লেনের বাড়িটিতে। সেখানকারই কমলা বিদ্যামন্দিরে তাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। কমলা বিদ্যামন্দিরেই সুকান্তের সাহিত্যের হাতেখড়ি হয়। বলা হয়ে থাকে, ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়’–সুকান্তের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। শৈশবেই তার সাহিত্যানুরাগ স্পষ্ট হতে থাকে। আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়’ এ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিন কয়েক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা ‘বিবেকানন্দের জীবনী’। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার মূল চরিত্রে অভিনয় সুকান্তকে বয়সের তুলনায় অনেক পরিপক্ক করে তুলেছিল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বাল্যবন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন।
কমলা বিদ্যামন্দিরে লেখাপড়ার পাঠ চুকবার পর সুকান্ত ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। সুকান্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালেই ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর প্রকাশনা ‘আকাল’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন তিনি সম্পাদনা করেন। ১৯৪৫ সালে সুকান্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন এবং অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় এখানে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
এ হলো সুকান্তের আনুষ্ঠানিক জীবনের কথা।
সুকান্তের কবি জীবন সত্যিকার অর্থে শুরু হয় যখন তাঁর বয়স চৌদ্দ কি পনেরো। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চৌদ্দ বছরের বালক সুকান্তের কবিতার খাতা পড়ে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁকে সুকান্ত কবিতা দেখাতেন, পরিমার্জন আশা করতেন। এক স্মৃতিচারণে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেন, ‘কীভাবে কবিতা লিখতে হবে তার জন্য সুকান্ত তাঁর কাছে আসতেন, কিন্তু কী লিখতে হবে সেই সংকট তার কখনোই ছিল না।’
এরই মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এসে পড়ে কলকাতায়ও। মানবতা তখন লাঞ্ছিত। যুদ্ধের তা-বলীলা চোখের সামনে তখনো দেখা না গেলেও এর ভয়াবহতা অনুমান করে সবাই শঙ্কিত। তবে এসব কিছু তিনি শুধু অবলোকনই করেননি, মানবতার লাঞ্ছনার অপনোদনে রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা। এ সময় সুকান্ত বেশ কিছু কবিতা লেখেন। পূর্বাভাস গ্রন্থে এসব কবিতা সংকলিত হয়েছে। স্বভাবগতভাবেই সুকান্ত গভীর ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তার কবিতায়। পরাধীন দেশের দুঃখ-দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণমুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্মজীবন এবং ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা। পৃথিবীব্যাপী অনাচার-অত্যাচারের বিরোধিতার পাশাপাশি নিজ দেশে যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হন। কবিতায়, চিঠিপত্রে, নাটিকা, গল্প-গানে সর্বত্র তার একই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’, ‘চাষি-মজুর’ বিষয়গুলোকে বিশ্বস্ততা ও প্রতিশ্রুতি-র সাথে তিনি তুলে ধরেছেন। সৃষ্টির বেদনার অস্থিরতা তার ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল সেসময়ে। বিতর্ক চর্চা, আলোচনা, গান, নাটক, কবিতা পাঠের আয়োজনকে মার্কসবাদের প্রচার ও বিপ্লবী চেতনার সৃষ্টির হাতিয়ার ছিল, এরই বাহক ছিলেন অন্য সবার মতো সুকান্তও। দেশব্যাপী গণআন্দোলনের বৃহৎ জোয়ারে যুক্ত হয়ে সুকান্ত যে তীক্ষ্মধী ও মেধাবী ভাষায় কবিতা রচনা করলেন তা বিস্ময়কর। যুগ চেতনা নয় শুধু, যুগে যুগে দেশে দেশে অত্যাচার-অনাচার-শোষণের বিরুদ্ধে সুকান্তের কবিতা মূর্তিমান কবিতা।
১৯৪১ সালে সুকান্ত কলকাতা রেডিও-র গল্পদাদুর আসরের যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর তাঁর সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল মাত্র কবি ছিলেন না, সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ। তেমনি সুকান্তও ওই বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্ত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন।
বিপ্লবী রোমান্টসিজম বা প্রথাগত কমিউনিজমের আদতে নয়, প্রকৃতঅর্থে কমিউনিজম ছিল সুকান্তের প্রেরণা, ধ্যান-জ্ঞান। এক্ষেত্রে কলম ছিল তার সংগ্রামের সাথী। আর খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ ছিল তাঁর বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি ও সৃষ্টির মৌলিক উপাদান। কমিউনিজমের দর্শনের আলোয় প্রতিনিয়ত তিনি চেতনাকে শান দিতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। বিত্তহীন, গরিব, মুটে, মজুর-কৃষক, অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণি বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুকান্তের কবিতা পাঠে কতোগুলো বিষয় আমাদের কাছে চিহ্নিত। যেমন সাম্রাজ্যবাদীদের চিহ্নিতকরণ, সাহিত্যকে শোষণমুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করা, মনুষ্যসৃষ্ট তথা দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, যুদ্ধের বিরোধিতা করা উল্লেখযোগ্য। উদ্যোগ, অনুভব, লেনিন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি, ছাড়পত্র, জনরব–এসব কবিতায় আমরা তার নিদর্শন পাই। মার্কসবাদী কিংবা একটি রাজনৈতিক আদর্শের কবি হওয়ার কারণে যারা সুকান্তকে অবহেলা করেন, বা আড়াল করেন, তারা আরো অনেক কিছুই বলতে কিংবা করতে পারেন। কিন্তু ‘ছাড়পত্র’-এরই ‘ঐতিহাসিক’ নামের প্রায়-ঐতিহাসিক এক কবিতায় সুকান্ত বোধ হয়, এদের উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন গভীর দার্শনিকতা-কাব্যিকতার ক’টি অমোঘ লাইন। মার্কস ধর্মকে পর্যন্ত বলেছিলেন ‘হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়’, ‘নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস’ এবং শেষ পর্যন্ত ‘জনগণের আফিম’। এরকম প্রতিটি বাক্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, গভীরভাবে বিবেচ্য। সুকান্ত অবশ্য ধর্মে পৌঁছে যাননি, কিন্তু বিবৃতি-তে তিনি তা উল্লেখ করায় বোঝা যায়, তার সম্ভাবনাটা তিনি বাতিল করেন নি। হৃদয়হীন পৃথিবীকে সহৃদয় ক’রে গড়ে তোলার আয়োজনে যান্ত্রিক মনোভাবের ক্ষতিটা ব্যাপক।
অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। বরং রাজপথে শোষিত মানুষের অধিকার আদায় ও শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার সংগ্রাম আর লেখালেখির মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার অবিচল অঙ্গিকারে তিনি ছিলেন ইস্পাতদৃঢ়। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংঘঠিত করে তোলে। সুকান্তের লেখনি গভীরভাবে প্রভাবিত হতো তার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে সুকান্তের যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিলো, তাই তিনি ঢেলে দিতেন কলমে-কাগজে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। কবিতায় যতটা গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেন তা অনেক কবিই পারেননি। যে কারণে তাঁকে ‘গণমানুষের কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যদিও সমালোচকরা বলেন, তিনি কবিতাকে স্লোগানে উচ্চকিত করেছেন। এ কথা সত্য, সুকান্তের অধিকাংশ কবিতা সরাসরি রাজনৈতিক কবিতা, শ্রেণি চেতনায় সমৃদ্ধ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের অঙ্গিকারে বলিষ্ঠ এবং সর্বোপরি মার্কসবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত। তার মৃত্যুর পর কবি বুদ্ধদেব বসু কবি প্রতিভার প্রশংসা করেও বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয় করেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।’ বুদ্ধদেব একই প্রবন্ধে ‘তথাকথিত বৈজ্ঞানিক মকবাদের’ কথা বলে মার্কসবাদকেই তাচ্ছিল্য করেছেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত প্রমুখ কবিরা art for art’s sake তত্ত্বে বিশ্বাস করেন এবং তারা প্রগতির সাহিত্যের প্রগতির ধারাকে বুঝতেই পারলেন না। প্রগতি সাহিত্যের বিরুদ্ধে এমন সমালোচনা সবসময়ই ছিল। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ এই তত্ত্বে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আর্টের ধোঁয়ায় এদের চোখ কটকট করে না, শিল্পীর কর্তব্য সম্বন্ধে এদের দ্বিধাও নেই। দুর্বলতাও নেই।’
সুকান্তের জীবদ্দশায় তিনি নিজের কবিতা সমাদৃত হ’তে দেখেছেন। নানা পত্র-পত্রিকায় দেশে-বিদেশে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। অনূদিত হয়েছে। অসুস্থাবস্থায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন চলছিল, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এই বইয়ের সমস্ত কবিতাগুলো হাসপাতাল নিয়ে গিয়ে যখন সুকান্ত-র হাতে দেয়া হয়, তখন সে আনন্দ উঠে বসেছিল। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই তার আকস্মিক প্রয়াণে কিছুটা থমকে নামকরণ করে ১৯৪৭ সালে তা প্রকাশিত হয়। ‘ছাড়পত্র’ শীর্ষক এ গ্রন্থটিতেই কবিমানস সৃষ্টি।
তাঁর অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো : পূর্বাভাস (১৯৫০, কাব্যগ্রন্থ), মিঠেকড়া (১৯৫১, ছড়া), অভিযান (১৯৫৩, নাটিকা), ঘুম নেই (১৯৫৪, কাব্যগ্রন্থ), হরতাল (১৯৬২, গল্প), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫, গানের সংকলন) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে দুই বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। বলাবাহুল্য, তার সবগুলো বই-ই প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর পর।
‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ গঠিত হলে ক্রমেই তিনি চলে এলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে। দিন-ক্ষণ না থাকলেও নানা মতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ১৯৪১-এর দিকেই সুকান্ত রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালের মধ্যেই তিনি ছাত্র রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হন। জনরক্ষা সমিতিকে কেন্দ্র করে তিনি পার্টির প্রচার ও সাংগঠনিক নিয়মিত কাজে যুক্ত থাকেন। নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য–তাঁর সময়কার সবচেয়ে অল্পবয়সী পার্টি-সদস্যও বটে। সে সময় নিয়মিত মিছিলে যাওয়া, সভা-সমিতি করা হয়ে উঠল তাঁর দায়িত্বের অংশ। এখানেই শেষ নয়, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন গঠিত ‘কিশোর বাহিনী’র সক্রিয় সংগঠক ও নেতা। তাঁরই উদ্যোগে শহরে-নগরে-সর্বত্র গড়ে উঠল ‘কিশোর বাহিনী’। একই সঙ্গে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এভাবে মাত্র ২১ বছরের আয়ুষ্কালে সমগুরুত্বের সঙ্গে সুকান্ত অসামান্য। বিত্তের দিক দিয়ে সচ্ছলতা তার গৃহে কখনো আসেনি।
একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমিনিস্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা-র ‘কিশোর সভা’ বিভাগ তিনি সম্পাদনা করতেন। তখন বিভিন্ন স্থানে এর শাখাও গড়ে উঠেছিল। তাই পার্টির কাজ, নিজস্ব লেখালেখির পাশাপাশি শাখার কমরেডদের প্রচুর চিঠি ও পোস্ট কার্ড লিখলেন। এ দিকটি লক্ষ্য করলে ও চিঠি পাঠে দেখা যায়, তিনি শুধু কবি হতে চাননি, চেয়েছিলেন সবার ভেতরেই সৃষ্টির স্ফূরণ ঘটুক। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তাঁর শরীরে। প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মাত্র কলকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬-৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী। কিন্তু বামপন্থি রাজনৈতিক ও সাহিত্য-শিবিরে সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। গণমাধ্যমগুলোতেও তিনি উপেক্ষিত। সত্তুর দশকে মুক্তির সংগ্রামে তরুণদের মধ্যে সুকান্ত প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। আবার নব্বই দশকে এসে তা অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য। প্রশ্ন হলো মার্কসবাদে দীক্ষিত এ কবিকে এখনও আমরা স্মরণ করি কেন? সুকান্তের সমসাময়িক ছিল ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত। যুদ্ধ-ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ দ্বারা জর্জরিত। কিন্তু ১৯৪৭-র কৃত্রিম স্বাধীনতার ২৪ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও তিনি কেন আজো প্রাসঙ্গিক তা আমাদের ভাবায়। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। পরাধীন ভারতবর্ষ যুবকদের মনে উপ্ত করেছিল স্বাধীনতার বীজ। আর আজো নানামুখি অস্থির-নেতিবাচক অবস্থার ভেতর দিয়ে তরুণদের ভিন্নতর স্বপ্নে সুকান্তই ভরসাস্থল। সমভাবে তিনি আজো প্রাসঙ্গিক। এখনও কাব্যচর্চায় তার দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছেন এমন কবি সংখ্যা কম নয়। তাঁর ক্ষণজন্মা যাপিত জীবন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ করার তাগিদে অকুতোভয় যোদ্ধা হয়ে ওঠা, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়া প্রায় সবই অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠছে তার বিপ্লবী অভিমুখে। বিশেষ করে নানা প্রগতি-সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রে সুকান্ত ভট্টাচার্য আজো ‘বিপ্লবের রণধ্বনি’।


হাবীব ইমন : সভাপতি, যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর সংসদ

Comments