কেরানী তৈরির শিক্ষার অবসান হোক


মেহেদি হাসান নোবেল
সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো রক্ত মাংসে ভারতীয় কিন্তু সমনে মগজে ব্রিটিশ ধ্যান ধারণা সম্পন্ন কিছু চাকর তৈরি করা যাতে করে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কার্যক্রম অর্থাৎ শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখতে কোন অসুবিধা না হয়। পাকিস্তান আমলেও শিক্ষার উপর শাসকশ্রেণির আঘাত এসেছে বারাবার। এই আমলের ছাত্র সমাজ সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে সেই আঘাতকে প্রতিহত করেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এমন একটি রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভ্রূণ  তৈরি হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে। ব্রিটিশ শাসন গেল, পাকিস্তানি শাসকদের তাড়ালাম কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৯ বছরেও আমরা একটি মানবিক মানুষ তৈরির শিক্ষানীতি বা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলাম না। শুধু লিখতে বা পড়তে জানা বা কোন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করার জন্যই শিক্ষা নয়। শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে উঠবে প্রগতিশীল জাতীয় চেতনায়, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সততা ও নিষ্ঠায় এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ একটি জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও আমাদের রাষ্ট্র আমাদের যে শিক্ষা দিচ্ছে তা কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের মধ্যে, গ্রাম-শহরের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সীমাহীন বৈষম্য বিদ্যমান। একই ধারার গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। একই ধারায় শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় বিভক্ত মতাদর্শ নিয়ে জাতি গড়ে উঠছে। তাই এখনো কিছু মানুষ স্বাধীনতা বিরোধী মতাদর্শের সমর্থক। স্বাঘধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় তার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করে সে আন্দোলনে সামান্য হলেও তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ দেখা যায়। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় পশ্চাৎপদ মৌলবাদী মানসিকতায় মানুষ গড়ে উঠছে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী জামাত-শিবির যখন গুজব রটায় রাজাকার সাইদীকে চাঁদে দেখা গেছে, তখন অনেক শিক্ষিত মানুষও যক্তি বিবেচনা না কর অবলীলায় রাস্তায় নেমে আসে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসসাধনে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা এবং বাস্তব উপযোগিতাহীন ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতি এবং একই সাথে সাধারণ মাধ্যমের শিক্ষা একটি দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে বাধার সৃষ্টি করছে। তাই এখন পর্যন্ত জাতীয় সংগীত নিয়ে, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমরা জাতিগত হিসেবে একমত হতে পারিনি। তথাপি এই রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি বহুদাবিভক্ত শিক্ষা পদ্ধতি চালু রাখতে চায় সেই ব্রিটিশদের “ডিভাইড এন্ড রুল” পদ্ধতি ব্যবহার করে, যাতে তার লুটেরা শাসন পদ্ধতি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এখন সময় এসেছে একটি একই ধারার গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে এই লুটেরা শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
যতটুকু শিক্ষা এদেশের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে তাও আজ প্রবল বাণিজ্যিকীকরণের গ্রাসে পড়েছে। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর পক্ষে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয় না অথবা লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষার দিকে তাকালে আমরা দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েল চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি। যে কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলোকেও ইউজিসির কৌশলপত্রের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ধারায় পরিচালিত করার পাঁয়তারা চলছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সংকটের গর্ভ থেকে জন্ম নিচ্ছে কোচিং-প্রাইভেটের মতো ভয়ংকর ব্যাধি। যারা বাড়িতে প্রাইভেট টিউচর রাখার খরচ কুলাতে পারছে না, ভালো ফল করা তাদের জন্য অসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। তার তাই শিক্ষা লাভের মাপকাঠি আজ মেধার বদলে অর্থ। মুখস্তনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি চলছে যদিও সরকারি পদ্ধতিতে বলা হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতি। সেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে একজন অটিস কিংবা কমার্সের ছাত্র ইংরেজি পরীক্ষায় রচনা অংশে “এইম ইন লাইফ” রচনায় অবলীলায় লিখে দিচ্ছে। “আই ওয়ান্ট টু বি এ ডক্টর”। যদিও একজন অটিস বা কমার্সের শিক্ষার্থীর পক্ষে ডাক্তারি পড়া সম্ভব নয়। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে মাতৃভাষায় শিক্ষার বিপরীতে প্রথম শ্রেণি থেকেই বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিখানো হয়। ১২ বছর ধরে একটি ভাষা শেখার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য যে নূন্যতম মার্কস দরকার তাই পূরণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আসন শূন্য থাকছে শিক্ষার্থী ইংরেজিতে নূন্যতম মার্কস না থাকার কারণে। শিশুকাল থেকে চাপিয়ে দেয়ার ফলে ইংরেজি ভীতি আমাদের কাটছে না এবং আমরা ভাষাটি সঠিকভাবে শিখতে পারছি না। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার আর একটি সংকট শিক্ষকদের বেতন এবং মর্যাদা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ধারায় পরিচালিত বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন কম স্বভাবতই সামাজিক মর্যাদা ও নিম্নমুখী। উপযুক্ত মর্যাদা না থাকায়, সরকারের অপরিনামদর্শী নীতির কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। প্রশ্নফাঁস আজ মহামারীতে পরিণত হয়েছে। পিইসিই (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) পরীক্ষা থেকে শুরু করে পিএসসি (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক মেরুদ- ভেঙে দিয়ে একটি নৈতিকভাবে দুর্বল জাতি গঠনের চক্রান্ত চলছে। যাতে করে শাসকশ্রেণির দুর্নীতি, লুটপাট নিয়ে নৈতিকভাবে দুর্বল মানুষরা প্রশ্ন করতে না পারে।
রাষ্ট্রীয় কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে মানবিক বোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরির শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে চাইলে প্রয়োজন ৬২’র ন্যায় একটি শিক্ষা আন্দোলন। ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই পারে মানবিক সমাজ গঠনের শিক্ষা নীতির সংগ্রাম গড়ে তুলতে, শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনে ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধতা এখন সময়ের প্রয়োজন।

Comments