প্রদীপ বর্মণ
গত এক দশকে অর্থনৈতিক ভাবে দেশের যে উন্নয়ন তা পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই সত্য কিন্তু যে উন্নয়নের জোয়ারে আমরা ভাসছি তা বস্তুগত। বস্তুগত উন্নয়নে আমরা কিছুটা এগিয়েছি যেমন বড় বড় ভবন হচ্ছে, পদ্মা সেতু হচ্ছে, সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে, কিন্তু মনোজগতের পরিবর্তনের জন্য কোন তাগিদ নেই স্বাধীনতা পরবর্তী কোন শাসকগোষ্ঠীর। আজকে হেফাজতের নীতিতে চলছে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম। পাঠ্যপুস্তকে কুসুমকুমারী দাসের লেখাকে বিকৃত করা হচ্ছে, বাদ দেয়া হচ্ছে সত্যেন সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মত লেখকদের লেখা। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষায় যে বিভাজন আজ তা আরও আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে শ্রেণি বৈষ্যমের বিষয়টিকে। একদিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, নামে বেনামে গড়ে উঠা কিন্ডার গার্টেন অপরদিকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে গড়ে উঠা বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউসেপ শিক্ষা দিচ্ছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যা ছয় মাসে এক বছর বিবেচিত হচ্ছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থী কোনভাবে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। ফলে বিভিন্ন শহর-গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পড়াশুনা করে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেকখানি দূরে সরে যাচ্ছে, ঠিক যেমনটা কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। কওমি মাদ্রাসায় সর্বোচ্চ সনদ দাওয়ায়ে হাদিস পাশ করা একজন ছাত্র ইংরেজিতে ইংলিশ বানান করার যোগ্যতা রাখে না। কারণ তাকে আরবী শিক্ষার বাহিরে কোন শিক্ষা প্রদান করা হয় না। অথচ আমাদের সরকার প্রধান দাওয়ায়ে হাদিসকে মাষ্টার্স সমমানের পদমর্যদা দিয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত করেছেন। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠা লক্ষাধিক কওমি মাদ্রাসায় পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা একেবারেই সমাজের নিম্নস্তরে থাকা খেটে খাওয়া মানুষের সন্তান। যারা চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন কোন দিনই দেখতে পাবে না। চলমান শিক্ষানীতিতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চলে না। এগুলো চলছে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মূলত চট্রগ্রামের হাটহাজারী থেকে। আর মূলধারায় থাকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। ক্লাস সংকট, শিক্ষক সংকট লেগে থাকা এই প্রতিষ্ঠান গুলোতে এখন পড়াশুনা করছে গ্রাম কিংবা শহরের খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানেরা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের কোন উদ্দ্যেগ নেই। যে উদ্দ্যেগ গ্রহণ করা হয়েছে তা শিশুমনে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে। শৈশবেই বেঁধে দেয়া হয়েছে পিইসি নামক পাবলিক পরীক্ষার যাতাকলে। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত কোন পাবলিক পরীক্ষা নেই। সেখানে আমাদের দেশে আঠারো বছর বয়সেই চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীকে। পিইসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণেও এক চরম বৈষম্য বিদ্যমান। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্য সূচীতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোন গ্রামাটিক্যাল সিস্টেম চালু নেই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ানো হচ্ছে বোর্ড নির্ধারিত বই ছয়টি। এর মধ্যে ইংরেজি এবং বাংলা বইতে গ্রামারের সংজ্ঞা বা ব্যাকরণের সংজ্ঞা পর্যন্ত নেই। অথচ পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্ন আসছে ভাষান্তরের, প্রশ্ন আসছে উক্তি, পদ প্রকরণ থেকে কিন্তু প্রাথমিকে ইংরেজি বা বাংলা বইটিতে এগুলোর উল্লেখ পর্যন্ত নেই। কিন্ডার গার্টেন কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেখানে প্রথম শ্রেণিতে উঠার আগেই শিখানো হচ্ছে গ্রামেটিক্যাল সিস্টেম। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ছে অ-তে অজু, অজু করে নামাযে যাই। গ-তে গান, গান শোনা ভাল নয়। চলমান এই প্রতিযোগিতা মূলক শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী দশমিক পাঁচ নম্বরের জন্য মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। আর প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষা ও বাংলা ভাষার সৃজনশীল ধারনা সম্পর্কে অজ্ঞতা রেখেই সম্পন্ন করছে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর। এই ব্যবস্থায় ভূক্তভোগী সাধারণ গরীব মানুষের সন্তানেরা কারণ ধনিক শ্রেণির মানুষের সন্তানেরা লেখাপড়া করছে মাসে প্রায় ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ করে ক্যান্ট পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা শহুরে নামীদামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কলেজ গুলোতে। আর এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বার্ণিজ্যিকীকরণের ফলে একজন শ্রমজীবি মানুষের সন্তানের শেষ আশ্রয়স্থল ঐ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে। বর্তমান এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বৈষম্য এতে করে বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত ছেলেমেয়েরাই বেশি পরিমানে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবে আর গরীব মানুষের সন্তানেরা ঝরে পরবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনের আগেই। প্রচলিত এই শিক্ষা কাঠামোকে ভেঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার যুগোপযোগীকরণ করে একটি একই ধারার বিজ্ঞান ভিত্তিক গণমুখী অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে না তোলা পর্যন্ত একটি আদর্শিক শোষণ মুক্ত ন্যায়-পরায়ণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই আসুন একই ধারার বিজ্ঞান ভিত্তিক গণমুখী অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে নীল পতাকা তলে সমবেত হয়ে আওয়াজ তুলি-
সবার জন্য শিক্ষা চাই
বিকশিত জীবন চাই।
প্রদীপ বর্মণ : সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদ ; সভাপতি, রংপুর জেলা সংসদ।
সবার জন্য শিক্ষা চাই
বিকশিত জীবন চাই।
প্রদীপ বর্মণ : সহ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদ ; সভাপতি, রংপুর জেলা সংসদ।
Comments
Post a Comment