বাবু মল্লিক :
একাত্তরের যুদ্ধের বীর সেনা, তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপির পুত্র হয়েও ধন-রত্নের পেছনে না ছুটে যিনি নির্লোভ-নিরহংকারী সংসপ্তক বিশ্বের নিপীড়িত জনতার মুক্তির প্রত্যাশায় জীবন বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনি মতিউল ইসলাম। ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ এর শহীদ মতিউলের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়ে গেল সম্প্রতি। ভিয়েতনামের জনগণের বীরোচিত সংগ্রামে সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ‘ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ পালনের ডাক দেয়। ডাকসু’র তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহবুব জামান প্রমুখের নেতৃত্বে ঐ দিন একটি বিশাল মিছিল বের হয়ে মতিঝিলের ‘আদমনি কোর্ট’ ভবনে অবস্থিত দূতাবাস অভিমুখে এগিয়ে যায়। মিছিলটি ঢাকা প্রেসক্লাবের বিপরীতে তোপখানা রোডে অবস্থিত মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের (ইউসিস) সামনে কাছাকাছি আসামাত্র পুলিশ বিনা উস্কানিতে ও কোনো ধরনের সতর্কতা না জানিয়েই মিছিলে অতর্তিতে গুলি চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাজবাড়ীর পাংশা থানার মতিউল ইসলাম ও টাঙ্গাইলের মির্জা কাদেরুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মতিউলের বয়স ছিল ২১ বছর, ডাক নাম ছিল তার মালু। জহুরুল হক হলের ১৪৮ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র মতিউল সে সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন হল শাখার প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মতিউলের শহীদ সহযোদ্ধা ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী, ঢাকা কলেজের মির্জা কাদেরের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।
নীতি ও আদর্শের ধারক ও বাহক মতিউল ইসলাম ছিলেন এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তার পিতা মোসলেম উদ্দিন মৃধা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের শ্রমিক রাজনীতির এক প্রবাদপুরুষ। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু। অল বেঙ্গল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক, ওই কমিটির সভাপতি ভিবি গিরি উত্তরকালে ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মোসলেম উদ্দীন মৃধা তার গ্রামের হাবাসপুর কাসিমবাজার রাজ হাইস্কুলে ১০ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান শিক্ষকের চাকরী থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে ১৯৭০-এর নির্বাচনে ফরিদপুর-২ আসনের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের মোট ৫ সদস্য সক্রিয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র মতিউল তাঁর পিতা এবং চাচাতো ভাই নৌ-কমান্ডো শহীদ খবিরুজ্জামান (বীর বিক্রম) সহ ভারতে চলে যান। পিতা মোসলেম উদ্দীন মৃধা কল্যাণী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর মতিউল ইসলাম চাকুলিয়ায় ছয় সপ্তাহের সিএনসি স্পেশাল ট্রেনিং গ্রহণ করে কুমিল্লার কসবা সীমান্ত দিয়ে দেশের ভিতর ঢুকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন পাংশার খান আব্দুল হাই, দুলাল, মোজাম, সেলিম, ফরিদপুরের বাবুল রশীদ (পরে নাট্যশিল্পী)। এই যুদ্ধে ৭ জন মারা যায়। কসবা দিয়ে দেশের ভিতর ঢুকে নিজ এলাকা ফরিদপুর পৌঁছানো নিরাপদ না হওয়ায় পরে ঝিনাইদহের মহেশপুরের সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ হয়ে গড়াই নদী পার হয়ে নিজের এলাকা হাবাসপুর পৌঁছান। অতপর তিনি সহযোদ্ধাদের সাথে বালিয়াকান্দির রামদিয়া, রাজবাড়ী সদরের সূর্যনগর, নটাপাড়া এলাকায় রেলব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার অপারেশন সহ বিভিন্ন অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা মতিউল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তার প্রিয় বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সাথেও তিনি যুক্ত হন। তিনি ‘সাপ্তাহিক একতা’ সহকর্মীদের রুমে রুমে পৌঁছে দিতেন। নব্য স্বাধীন দেশের একজন এম.সি.এ-এর ছেলে হয়েও বামপন্থি একটি সংগঠনে কাজ করার জন্য অনেকেই বিস্ময় ও তার প্রতি অসন্তষ্টি প্রকাশ করতেন। কিন্তু তাদের পিছুটানে কর্ণপাত করেনি প্রগতিশীল সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মী মতিউল। আদর্শবাদী ও মহৎ চরিত্রের অনুসারী মতিউল রাজনৈতিক মহান লক্ষ্যে তাই সরকারি দলের স্রোতে না গিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ধারায় নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন এবং বিশ্বের নিপীড়িত জনতার লড়াই-সংগ্রামের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে মিছিলের সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে শ্লোগান তুলতে গিয়ে আত্মহুতি দিয়েছিলেন।
মতিউল-কাদের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা সেদিন উত্তাল হয়েছিল। পল্টনের জনসভায় ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকসুর নেতারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশে ওই প্রথম পুলিশের গুলিতে শহীদ ২ ছাত্রের লাশ সামনে নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন পরদিন ২ জানুয়ারি ১৯৭৩ ঢাকায় পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করলে তা স্বতস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান প্রমুখ ছাত্রনেতারা সেদিন ক্ষোভ-দুঃখে-প্রতিবাদে পল্টন ময়দান প্রকম্পিত করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়া হয়। তোপখানা সড়কের মাঝখানে মতিউল-কাদের স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্তম্ভের পাদদেশ। ইউসিস ভবনের গায়ে লেখা হয় ‘শহীদ মতিউল-কাদের পাঠাগার’। ঐ ভবনের ছাদ থেকে মার্কিন পতাকা নামিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় ভিয়েতনামের জাতীয় পতাকা। বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ফোয়ারার একপাশে মতিউল-কাদেররে স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি স্তম্ভ’। এখানে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি অসংখ্য সংগঠন পুষ্পমাল্য অর্পণ সহ নানা অনুষ্ঠান করে থাকে।
শহীদ মতিউলের লাশ সেদিন তার নিজের এলাকা পাংশার হাবাসপুর গ্রামে পৌঁছার পর জনগণের মনে তীব্র আবেগ সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ও মুক্তিযুদ্ধের একজন সশস্ত্র যোদ্ধার লাশ কাঁধ থেকে বাহাদুরপুরের কবরস্থানে নামাতে গিয়ে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। সহযোদ্ধারা অশ্রু সংবরণ করে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠেন। মতিউলের বাড়িতে পিতা মোসলেম উদ্দীন মৃধার মাথার ওপরে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের ছবিটি নামিয়ে এনে তছনছ করেন এলাকার সহযোদ্ধা-সহপাঠী ও ক্ষুব্ধ জনতার দল। অবশ্য এরই পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে মনোনয়ন হারালেন শহীদ মতিউলের পিতা মোসলেম উদ্দীন মৃধা। মনোনয়ন পেলেন বাষট্টিতে আইয়ুব খানের বি.ডি (বেসিক ডেমোক্যাট) নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগার মাছপাড়ার খন্দকার নুরুন্নবী।
শহীদ মতিউলের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ২০০১ সালে ভিয়েতনাম সরকার মতিউলকে বিরল রাষ্ট্্রীয় সম্মানে ভূষিত করে। তার পরিবারের হাতে একটি স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে শহীদ মতিউলকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার এক অফুরন্ত উৎস মতিউল তাঁর অনুসারীদের স্মৃতিতে এখনও জাগরুক। মৃত্যুর এত বছর পরও তার সহযোদ্ধা, অনুসারীরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সকালে রাজবাড়ী থেকে ছাত্র ইউনিয়ন জেলা সংসদের (কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরাও থাকেন সাথে) মৌনমিছিল করে। মিছিল গিয়ে থামে বাহাদুরপুরের তারাপুর কবরস্থানে। সেখানে যোগ হয় এলাকার ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ আর আশপাশের এলাকা থেকে আসা সহপাঠী-সহকর্মীরা। মতিউলের স্মৃতিসৌধে ফুলের মালা দিয়ে তারা নীরবে শ্রদ্ধা জানান, স্মৃতিচারণ করেন এবং তার বিপ্লবী জীবনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেন। তার ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। শহীদ মতিউল ইসলাম অমর হোক।
লেখক : যুব ইউনিয়নের সাবেক নেতা
আরও পড়ুন : পহেলা জানুয়ারি ১৯৭৩ কী হয়েছিল?
আরও পড়ুন : পহেলা জানুয়ারি ১৯৭৩ কী হয়েছিল?
Comments
Post a Comment