সৌন্দর্য বনাম যোগ্যতা


নুসরাত জাহান মিম
সেইসব মেয়েরা,যারা আজ প্রতিষ্ঠিত তাদের সাফল্যের পেছনে সমাজের হাজার হাজার মানুষের অবদান রয়েছে। 'ইশ! মেয়ে এত বড় হল বিয়ে হয় না কেন! মেয়ে রান্না পারে না,কিভাবে সংসার করবে! মেয়ে কি কারো রে বাবা! রাত ১০টায় ফেরে,কি না যেন করে! পর্দা তো  করেই না,ওড়নারই খবর নাই! মেয়ে চশমা পড়ে কেন! ' ইত্যাদি কলরবে যাদের চারপাশ গুঞ্জিত হয় নিত্যদিন,২০বছর পর সেই মেয়েটাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়ার তালিকায় থাকে। তথাকথিত ভদ্র মেয়েদের কপালে স্বামীর মার কিংবা তালাক, ২-৩টা সন্তান এবং সমাজের ও পরিবারের বোঝা হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা সুবিধাজনক অবস্থান হল তারা নারীর বিরুদ্ধে নারীকে লেলিয়ে দেয়। এজন্যই সতী বনাম পতিতা,সুন্দরী বনাম কৃষ্ণকলি,লক্ষী বনাম অলক্ষী,ভদ্র বনাম নষ্টা তুলনাগুলোর উৎপত্তি। লক্ষ্য করলে দেখা যায়,পুরুষ নয় নারীরাই বেশি একে অপরের সমালোচনায় ব্যস্ত। যেমন,কোন ঘরের মেয়ে পালিয়ে গেল,কার বউ কতখানি সুন্দরী,কোন ঘরের বোনদের মধ্যে কে বেশি ভদ্র,কে মাথায় কাপড় দেয় না। নারী যত ঘরে রয় তত সতী,যত স্বামীর হাতে মার খায় তত ভদ্র,যত কম কথা বলে তত যোগ্য,যত ফর্সা তত উন্নত।
বাংলাদেশে নারীরা আজন্ম শিখে এসেছে সৌন্দর্য বলতে সুন্দর করে চুল বাঁধা,লিপস্টিক দেয়া বোঝায় অথচ বুদ্ধি ও জ্ঞানের চর্চা যে তার সাথে অপরিহার্য তা তাকে শেখানো হয় নি। নারী সাজবে তার নিজের জন্য কিন্তু এদেশের নারীর সজ্জা অন্যের মন্তব্যে ঠাসা সার্টিফিকেট এর ওপর নির্ভর করে। রুপ,চুল সর্বদাই নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ করে,যোগ্যতা নয়। প্রতিটা মেয়ে যদি চুলের গোড়ায় তেল দেওয়ার পাশাপাশি তার গভীরে থাকা মগজেও জ্ঞানের তেল ঢালে তবে তাদের এ অসহায় অবস্থার মুক্তি ঘটত।
আমরা সম্প্রতি মিস বাংলাদেশ,২০১৮ এর প্রতিযোগিতায় এক প্রতিযোগীর দেখেছি যে কি না রসায়নের একটা সাধারন প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম ছিল। উক্ত প্রতিযোগীর এই অযোগ্যতার পেছনে দায়ী সে একা নাকি সমাজ,রাষ্ট্রও এর জন্য সমান দায়ী! আমাদের মেয়েদের যেখানে শুধু শেখানো হয় লিপস্টিকের একটি কালারের ১৩টি শেড,সেই সমাজ থেকে আমরা কি পেতে পারি এর থেকে বেশি! যে দেশে মেয়েদের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সার্টিফিকেট এ কালচে রঙ ধরে, সাইকেল চালানোকে বেইজ্জতি ধরা হয়, ক্রিকেট খেলা নোংরামি বলা হয়, দেরীতে ঘরে ফেরা অবাধ্যতা ধরা হয় ইত্যাদি, সে দেশে কি করে আমরা এর থেকে বেশি আশা করব! আমরা এখনো বিয়ের কনের গায়ের রং দেখি, তার ১০-১২টা যোগ্যতা দেখি না ; তার মাছের ঝোল রান্না পরখ করি,তার মাছ ধরতে পারার পাকা হাত উপেক্ষা করে যাই ; তার মাথায় ওপর এক হাত কাপড় আছে কি না পরীক্ষা করি, অথচ মেয়েটাকে খোলা চুলে হয়ত আরো সুন্দর লাগে! রান্নায় যেমন লবন ছাড়া বিস্বাদ লাগে তেমনিই আগুন ছাড়া তা যেমন ছিল তেমনই রয়ে যায়! আমাদের মেয়েরা লবন এর মত,তারা আগুন হয়ে উঠতে পারে নি। অবশ্যই আগে জ্ঞানচর্চা দরকার এবং প্রচুর পরিমানে দরকার। মেয়েদের তাই বয়স ১৮হলেই আরো একগাদা জ্ঞানমূলক বই দিন,৫'১০ইঞ্চি উচ্চতার ৫০০০০টাকা মাইনে পাওয়া স্বামী নয় এবং এর আগে বিয়ে তো হারাম করেই দিন। মেয়েদের মানুষ বানান,পণ্য নয়।
বিয়ে কে একটা মেয়ের ১৬ আনা হিসেব করে যুগ যুগ ধরে তাদের কীট এর চেয়েও নগন্য জীবন ধারনে বাধ্য করা হয়। স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় চওড়া সিঁথি পড়া মেয়েটা শাখা-পলার বিভৎস ইতিহাস জানেনা ; জানেনা নারীদের সহস্র বছর পূর্বে বন্দী করে রাখা হত হাতে-পায়ে-কোমড়ে বেড়ি পড়িয়ে,চুল পরিমান না নড়তে পারা নিশ্চিতকরণে নাকে ছিদ্র করে শেকলে বাঁধা হত যাকে এখন আমরা মেয়েলি সাজের অপরিহার্য উপাদান বলে চিনি। অবশ্য এখন যুগ বদলেছে,মেয়েরা নিজেদের সম্মান অর্জনে সচেষ্ট হয়েছে। এখন মেয়েরা গোলক বলতে শুধু চুড়ি-বালা নয় ফুটবল ও চেনে এবং টিপ যা শুধু নারীত্বের পরিচায়ক ছিল, তা এখন স্বাধীনতার প্রতীক যা মৌলবাদের বিপক্ষে কঠোর জবাব।
‌নারী মানেই সুন্দর; হোক সে কালো, শ্যামবর্ণ, উজ্জ্বল, গৌর, তামাটে কিংবা খাটো, লম্বা, বেঁটে। নারীর নাক টিকালো হোক বা বোঁচা, চোখ আয়ত হোক কিংবা গোল, কণ্ঠস্বর সুরেলা হোক বা কর্কশ - প্রতিটি নারী সমানভাবে বেড়ে উঠুক সমান সম্মানে। আটপৌরে শাড়ির নিয়ম থেকে বেরিয়ে মেয়ের স্লিভলেস টি-শার্ট পড়া মানেই সে সকল পুরুষের ভোগের সম্পত্তি নয়। নারী সম্পত্তি নয় সম্পদ হোক সমাজের সমতায় ভরে তুলুক বিশ্বকে ভালবেসে।

নুসরাত জাহান মিম: কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বরিশাল জেলা সংসদ।

Comments