মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা, কথাবার্তা, লেখালেখি কম হচ্ছে না। মোটেও সন্দেহ নেই যে ভবিষ্যতে তা আরো হবে। আবেগ ও সমকালীনতার সীমা ছাড়িয়ে সেসব আলোচনায় ক্রমেই আরো গভীরতা আসবে। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ গুণাবলী ও সাথে সাথে তাঁর সীমাবদ্ধতা নিয়ে গভীরতর বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন হবে। নির্ধারণ করার চেষ্টা হবে, ইতিহাসের দিগন্ত বিস্তৃত পরিধিতে তার অবদানের স্বরূপ ও পরিমাণ। খোঁজার চেষ্টা হবে বঙ্গবন্ধুর শক্তির প্রধান উত্সকে। যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়, কি ছিল বঙ্গবন্ধুর শক্তির প্রধান উত্স, তাহলে সে প্রশ্নের জবাবে আমি বলবো, অনেক সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও শেষ বিচারে তিনি যে 'মানুষের' সাথে থাকার চেষ্টা করেছেন, সেটিই তার শক্তির প্রধান উত্স ছিল। 'মানুষের' সাথে থাকার নিরলস এই প্রচেষ্টার ফলেই তিনি জননায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সে কারণেই তিনি ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
কোনো মানুষই সর্বক্ষেত্রের ও সর্বকালের বিচারে সবধরনের দুর্বলতা সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত একেকটি বিমূর্ত বিশুদ্ধজন নয়। মানুষ ফেরেশতা নয়। কোনো মানুষের পক্ষেই সেরূপ হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রই হলো ইতিহাসের ফসল। এটি ইতিহাসেরই কথা। দেশ-কাল-পাত্র তথা space and time-এর কাঠামো ও প্রেক্ষাপটে এবং সমাজে তার শ্রেণীগত অবস্থানের আলোকেই ইতিহাসে একজন ব্যক্তির ভূমিকার সম্ভাবনা ও সীমা নির্ধারিত হয়। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে বলা যায়, শীর্ষ পর্যায়সহ যেকোনো পর্যায়ের নেতা বা কর্মীর ভূমিকা দলের চরিত্রের এবং দলের চরিত্র তার শ্রেণীভিত্তি দ্বারা নির্ধারিত গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। মুসলিম লীগের ঝাণ্ডা নিয়ে 'লড়কে লেংগে পাকিস্তান' আন্দোলনের আবর্তে তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভাবধারা গ্রহণ করেন। পরবর্তী প্রায় তিন দশক ধরে তিনি সেই ধারার রাজনীতিই করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি সেই দলের অবিসংবাদিত শীর্ষ নেতা বা সুপ্রিমো হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। সেই আওয়ামী লীগ দলটির নীতিতে নানা সময় এদিক-ওদিক ঘটলেও তাঁর শ্রেণীভিত্তি আগাগোড়াই (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল পর্যন্ত) ছিল বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া (এখন অবশ্য সেই দলের নেতৃত্বের ওপর লুটেরা ধনিক শ্রেণীর প্রভাবই প্রাধান্য)। বঙ্গবন্ধু নিজের শ্রেণী অবস্থানও ছিল সেরূপ। উদার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে তার মাঝে উপস্থিত ছিল বুর্জোয়া রক্ষণশীলতা ও এমনকি সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও কিছু উপাদান। দলের ও তার নিজের শ্রেণীভিত্তির এই বৈশিষ্ট্যের গণ্ডির মধ্যে থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন। এই সীমার মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এখানেই তার শক্তির নিদর্শন। একথা ঠিক যে, ইতিহাস রচনা করে জনগণ। তবে ইতিহাস সাথে সাথে একথাও বলে যে, ইতিহাস নির্মাণে ব্যক্তির ভূমিকাও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। দল ও শ্রেণীর সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকেও একজন ব্যক্তি সেই সীমাবদ্ধতাকে খানিকটা পরিমাণে অতিক্রম করে ও তাত্পর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ইতিহাসের চাহিদা অনুসারে অবদান রেখে, ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে উঠতে সক্ষম হন। বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সেরূপ এক অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। একথা বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যেমন একদিকে ছিলেন ইতিহাসের ফসল, তেমনই একই সাথে তিনি ছিলেন ইতিহাসের স্রষ্টা- রূপকার।
একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনা দ্বারাই একজন ব্যক্তির শ্রেণী অবস্থান নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটিই সাধারণ নিয়ম। অর্থনীতি হলো ভিত্তি কাঠামো। চেতনা, দর্শন, ভাবধারা, সংস্কৃতি, জীবনাদর্শ ইত্যাদি হলো উপরি কাঠামো। তবে একথাও সত্য যে, উপরি কাঠামোর এসব উপাদান ভিত্তি কাঠামোকে প্রভাবিত করে থাকে। বিশেষ ক্ষেত্রে সে প্রভাব নির্ধারণমূলকও হয়ে উঠতে পারে। কখনো কখনো ও কারো কারো ক্ষেত্রে শ্রেণীচ্যুতির ঘটনাও ঘটতে পারে। একে বলা হয় ডি-ক্লাসড (declassed) হওয়া। সে কারণেই দেখা যায় যে, শ্রমিক শ্রেণীর মধ্য থেকে আসা কেউ কেউ সচেতনভাবে মালিক শ্রেণীর স্বার্থের রক্ষক হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে মালিক শ্রেণীর ভাবাদর্শ ও জীবন দর্শনের অনুসারী। আবার অপরদিকে কখনো কখনো পারিবারিকভাবে মালিক শ্রেণীর (বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া) মাঝে জন্ম নেয়া ও বিকাশ লাভ করা কিছু মানুষ শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের রক্ষক হয়ে ওঠে এবং সেই শ্রেণীর ভাবধারা ও জীবন-দর্শনের অনুসারী শুধু নয়, তার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওঠে। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা এরকম মানুষ। বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীতে জন্ম নিলেও তারা নিজ শিবির ত্যাগ করে (শ্রেণীচ্যুত হয়ে) শ্রমিক শ্রেণীর শিবিরে নিজেকে বিলীন করে দেয়। এদের মাঝে সকলে অবশ্য শ্রেণীচ্যুত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পরিপূর্ণতার সাথে ও ধারাবাহিকভাবে শেষ পর্যন্ত ধারণ ও পালন করতে পারে না। তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিচ্যুতি। নিজেকে শ্রমিক শ্রেণীর একজন বলে জাহির করলেও তারা অনেকে সর্বহারার বিপ্লবী চেতনাকে আত্মস্থ করতে অক্ষম হয় এবং শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া ভাবাদর্শের বাহক হয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার শ্রেণীচ্যুত হওয়ার ভেক ধারণ করে সচেতনভাবে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকার আন্দোলনকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক হিসেবে তারা ভূমিকা পালন করে।
বঙ্গবন্ধু কখনোই নিজেকে শ্রেণীচ্যুত এবং সর্বহারার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন বলে মনে করতেন না। আগাগোড়াই তিনি ছিলেন বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত একজন অনন্য সাধারণ জাতীয়তাবাদী নেতা। তাঁর ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ অর্জন করেছিল সুস্পষ্ট প্রগতিমুখীনতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাতের ফলশ্রুতিতেই তা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর সবটাই কি কেবলই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর ফলস্বরূপ সৃষ্ট ছিল? এই প্রগতিমুখীনতা অর্জনের পেছনে কি ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কোনো ভূমিকা ছিল না? বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসম্বাদিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সন্দেহাতীতভাবে প্রগতিশীল মর্মবাণী সম্পন্ন। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয় যে তা সম্ভব হওয়ার পেছনে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রভাব থাকলেও সে প্রভাবকে মূর্ত রূপ দেয়া কখনোই সম্ভব হতো না, যদি সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ভূমিকা ও অবদান না থাকতো। আলকাতরায় লাল রং মিশালে তার রং-এ কোনো হেরফের ঘটে না। কিন্তু পানিতে সেই লাল রং মিশালে তার রং পুরো লাল না হলেও হালকা গোলাপী রং ধারণ করে। মুসলিম লীগের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের জন্ম দিতে বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সামিল হয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। মওলানা ভাসানীর মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও মজলুমের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রবক্তা না হয়ে উঠতে পারলেও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল ও চিহ্নিত দক্ষিণপন্থী সিনিয়ার নেতাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে দলকে উদ্ধার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারায় নিজের নেতৃত্বে দলকে সংহত করতে তিনি সক্ষম হন। চলমান গণসংগ্রামের সবরকম স্রোতধারাকে ধারণ করে চলার কৌশল গ্রহণের ফলে ইতিহাসের ঠিক নির্ধারণমূলক সময়টিতে তিনি বাঙালির স্বাধীকার সংগ্রামের নেতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। যেহেতু বামপন্থী ছিল চলমান গণআন্দোলনের একটি প্রধান ধারা, তাই তার প্রভাবে জাতীয় আন্দোলনও প্রগতিমুখীন চরিত্র অর্জনের সম্ভাবনায় পুষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রমিক-কৃষকের ব্যাপক অংশগ্রহণ এই প্রগতিমুখীন সম্ভাবনাকে আরো বলিষ্ঠ করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও প্রগতিশীল বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করে। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আরব রাষ্ট্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এসবের ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিমুখীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু সেই প্রগতির ধারাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার পথে নিজেকে সামিল করেন। নিজস্ব ধারা ও কৌশলে তিনি জাতিকে সেই পথে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন।
বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ধারা ও কৌশলে ছিল একাধারে বঙ্গবন্ধুর 'জনগণ মন অধিনায়কোচিত' প্রবণতার ও অন্যদিকে তার শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। প্রতীকীভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর অর্ধেকটা মন জুড়ে ছিল মজলুম জননেতা ভাসানী (তার সাথে যুক্ত হয় কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ) আর বাকি অর্ধেকটা দখল করে ছিল গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে খ্যাত উদারনৈতিক বুর্জোয়া নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। হূদয় ও অনুভূতির টান একদিকে, আর বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীভিত্তির টান আরেক দিকে। একদিক থেকে প্রভাব মজলুম জনতার, অন্যদিক থেকে প্রভাব বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থ ও তাদের লক্ষ্য-আদর্শ-ভাবধারা। একদিকে শ্রমিক শ্রেণীসহ সমগ্র জনগণের কল্যাণ সাধনের আন্তরিক বাসনা, অন্যদিকে বুর্জোয়া রক্ষণশীলতা ও কিছু সামন্তবাদী পশ্চাত্পদতা। দু'দিকের শক্তি তাঁকে আগাগোড়াই ভিন্ন ভিন্ন পথে যেতে প্ররোচিত করেছে। এই দোটানা নিয়েই বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে একাধারে ছিল অনন্য শক্তি সামর্থ্য এবং সাথে সাথে তাতে ছিল অনেক অপূর্ণাঙ্গতা ও দুর্বলতা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে যেমন তাতে সামিল হয়েছিলেন, তেমনই একটি বড় অংশ তাতে যোগ দিয়েছিলেন ঘটনা পরম্পরার অভিঘাতে। প্রথম অংশকে বলা যায় Ideologically মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং দ্বিতীয় অংশকে আখ্যায়িত করা যায় Circumstantially মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরূপে। Ideology-র ক্ষেত্রেও পাশাপাশি প্রধানত দু'রকম প্রবণতার উপস্থিতি ছিল। একদিকে ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেতনা-ধারা। অন্যদিকে ছিল ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর দাঁড়ানো 'লাহোর প্রস্তাবের সঠিক বাস্তবায়নের' চেতনা-ধারা। পাকিস্তান প্রস্তাবের পহেলা ধারণাগত ভিত্তি ছিল লাহোর প্রস্তাবের মর্মকথা। সেখানে 'মুসলমানরা পৃথক জাতি' বলে মূল প্রতিপাদ্যটিকে মেনে নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের জন্য সুবিধাজনক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এই ধারণার সাথে জড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তানকে বিভক্ত করে মুসলিম বাংলা বা বাংলাস্থান প্রতিষ্ঠার ধারণা।
বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে দৃঢ় থাকলেও 'লাহোর প্রস্তাব পন্থীদেরকেও' সংগ্রামে সামিল করার পথ গ্রহণ করেন। আদর্শগতভাবে যথাযথ প্রস্তুতিহীন একটি বড় অংশের মানুষকে ঘটনাক্রমে (Circumstantially) পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামিল করার কৌশলও তিনি গ্রহণ করেন। এভাবে চেতনার নানা স্তরের মানুষকে নিয়ে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে বঙ্গবন্ধু সমর্থ হন। শ্রেণী স্বার্থের প্রশ্নেও তিনি শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া সকলের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে একই সাথে সমর্থন করার কথা বলতে থাকেন। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন সকল বাঙালির নেতা। লক্ষণীয় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের এসব যাবতীয় শক্তি ও দুর্বলতার প্রতিচ্ছায়া ছিলেন 'ব্যক্তি মুজিব'। সে কারণেই ইতিহাসের বিশেষ নির্ধারণমূলক কালে, তথা একাত্তরের পূর্বক্ষণে তিনি জাতির স্বাভাবিক নেতা হিসেবে নিজের স্থান করে নিতে পেরেছিলেন।
এ ধরনের অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে ইতিহাস সৃষ্টি করা সম্ভব হলেও সেই কাঠামোকে ধরে রেখে সরকার পরিচালনা ও রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর হিসেবে বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেও সেই সাময়িক জাতীয় ঐক্য অব্যাহত রাখতে পারেননি। তা করতে পারা সম্ভবও ছিল না। বঙ্গবন্ধু মার্কসবাদী ছিলেন না। শ্রেণী স্বার্থ কিভাবে তার সংহার শক্তি নিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মাঠে নামে, তা বঙ্গবন্ধু অনুমান করতে পারেননি। তিনি সব পক্ষকে খুশি রেখে চলতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে সব পক্ষই বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একাত্তরের সফল মুক্তিযুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যবাদ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তার আঁতে ঘা লেগেছিল মারাত্মকভাবে। সে অপেক্ষা করে বসেছিল প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। শত্রুর বর্বরতার মাত্রা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধির অভাব ও তা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাবের সুযোগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক দলের সহায়তায় সাম্রাজ্যবাদ আঘাত হেনেছিল। যে শ্রেণীগত ও ঐতিহাসিক সীমার মধ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুকে চলতে হয়েছে, তাতে তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে না পারাটাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। তা সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, সব সীমার মাঝে থেকেও তিনি 'মানুষের' কাছ থেকে কখনোই নিজেকে দূরে রাখেননি। জনগণই তাকে সীমার বাইরে যাওয়ার পথ ও প্রেরণা জুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান রচনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই হয়ে আছে ও তা থাকবে চিরকাল। ইতিহাসের এই অমোচনীয় আখ্যানের কথা বিবেচনা করেই হয়তো কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু লিখেছেন—
'যতোই হোক না সময় ও কাল বন্ধ্যা
মুজিবের জন্য নষ্ট হবে না হূদয়ের রজনীগন্ধা।'
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি



Comments
Post a Comment