পুরাণের পাখিরা

দীর্ঘ ৬৬ বছরের পদযাত্রায় ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতাকর্মী বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের সর্বোচ্চ সম্পদ- নিজেদের জীবন! তাঁদের নিয়ে বিশেষ আয়োজন আমাদের পাতায় সবসময় থাকবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লগ্নে আমরা প্রকাশ করলাম চারজনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। 

শহীদ মতিউল-কাদের: একাত্তরের যুদ্ধের বীর সেনা, তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপির পুত্র হয়েও ধন-রত্নের পেছনে না ছুটে যিনি নির্লোভ-নিরহংকারী সংসপ্তক বিশ্বের নিপীড়িত জনতার মুক্তির প্রত্যাশায় জীবন বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনি মতিউল ইসলাম। ভিয়েতনামের জনগণের বীরোচিত সংগ্রামে সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ‘ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ পালনের ডাক দেয়।
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারির পত্রিকায় মতিউল-কাদেরের শহীদ হওয়ার খবর
ডাকসু’র তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহবুব জামান প্রমুখের নেতৃত্বে ঐ দিন একটি বিশাল মিছিল বের হয়ে মতিঝিলের ‘আদমনি কোর্ট’ ভবনে অবস্থিত দূতাবাস অভিমুখে এগিয়ে যায়। মিছিলটি ঢাকা প্রেসক্লাবের বিপরীতে তোপখানা রোডে অবস্থিত মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের (ইউসিস) সামনে কাছাকাছি আসামাত্র পুলিশ বিনা উস্কানিতে ও কোনো ধরনের সতর্কতা না জানিয়েই মিছিলে অতর্তিতে গুলি চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাজবাড়ীর পাংশা থানার মতিউল ইসলাম ও টাঙ্গাইলের মির্জা কাদেরুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মতিউলের বয়স ছিল ২১ বছর, ডাক নাম ছিল তার মালু। জহুরুল হক হলের ১৪৮ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র মতিউল সে সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন হল শাখার প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মতিউলের শহীদ সহযোদ্ধা ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী, ঢাকা কলেজের মির্জা কাদেরের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।
মতিউল-কাদের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা সেদিন উত্তাল হয়েছিল। পল্টনের জনসভায় ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকসুর নেতারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশে ওই প্রথম পুলিশের গুলিতে শহীদ ২ ছাত্রের লাশ সামনে নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন পরদিন ২ জানুয়ারি ১৯৭৩ ঢাকায় পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করলে তা স্বতস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান প্রমুখ ছাত্রনেতারা সেদিন ক্ষোভ-দুঃখে-প্রতিবাদে পল্টন ময়দান প্রকম্পিত করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়া হয়। তোপখানা সড়কের মাঝখানে মতিউল-কাদের স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্তম্ভের পাদদেশ। ইউসিস ভবনের গায়ে লেখা হয় ‘শহীদ মতিউল-কাদের পাঠাগার’। ঐ ভবনের ছাদ থেকে মার্কিন পতাকা নামিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় ভিয়েতনামের জাতীয় পতাকা। বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ফোয়ারার একপাশে মতিউল-কাদেররে স্মৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি স্তম্ভ’। এখানে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি অসংখ্য সংগঠন পুষ্পমাল্য অর্পণ সহ নানা অনুষ্ঠান করে থাকে। ২০০১ সালে ভিয়েতনাম সরকার মতিউলকে বিরল রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করে। তার পরিবারের হাতে একটি স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে শহীদ মতিউলকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার এক অফুরন্ত উৎস মতিউল তাঁর অনুসারীদের স্মৃতিতে এখনও জাগরুক।

শহীদ সঞ্জয় তলাপাত্র : শহীদ সঞ্জয় তলাপাত্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় নাম।সঞ্জয়রা কোন দিন হারিয়ে যায় না। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে সঞ্জয় তলাপাত্র'রা।তাঁদের স্মৃতি বেঁচে থাকে অনন্তকাল।

১৯৯৮-এর আগস্টের আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন। ফলে সেই সময়ে প্রায় প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আর রেল স্টেশনে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। ২০ আগস্ট। সেদিন সকালে বটতলী স্টেশনে মিছিলের কোন কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার পূর্বে হঠাৎ শিবির কর্মীরা রড, লাঠি আর বাঁশ নিয়ে হামলা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।ফলে আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী।
সেদিনের ঘটনার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে বটতলী স্টেশনে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি হামলার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বড় মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেদিনের হামলার সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ ছিল স্টেশনে মৌলবাদী ঘাতকদের দ্বারা সঞ্জয়ের মারাত্মক আহত হওয়া।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সঞ্জয় খাতা আর তুলির ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সকালের শাটল ট্রেনে যেতে চেয়েছিল তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু মৌলবাদী চক্রের লাঠি আর রডের আঘাতে তাকে আর ক্যাম্পাসে পৌঁছতে দেয়নি। সঞ্জয় তলাপাত্রকে রক্তাক্ত অবস্থাতে নিয়ে যেতে হয়েছিলো হাসপাতালে।
কিন্তু দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টা ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ করে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ২২ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে সঞ্জয় চিরতরে চলে যায়।থমকে যায় সময়। থেমে যায় একটি প্রাণবন্ত জীবন।অনেক বেশি কষ্টের বিষয় ছিল সেদিনের ২২ আগস্ট ছিল সঞ্জয় তলাপাত্রে'র ২৪ তম জন্মদিন।

এখন পর্যন্ত সঞ্জয় তলাপাত্রের হত্যার কোন বিচার হয়নি।

শহীদ আবুল হাশেম: রংপুর জেলার কাউনিয়া থানার ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র নেতা আবুল হাশেম শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণ ও নকল বিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

শহীদ আবুল হাশেম মীরবাগ ধর্ম্মেরশ্বর মহেশা দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ের সাথে যুক্ত হন। শহীদ আবুল হাশেম কাউনিয়া উপজেলা শাখার গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন এবং রংপুর জেলা সংসদের সদস্য পদ পান। সে সময়ে রংপুরের ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিটি আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

১৯৯৮ সালে কাউনিয়া উপজেলা ছাত্র ইউনিয়ন দ্বারা পরিচালিত নকলবিরোধী ও শিক্ষা বাণিজ্যিকীরণ বিরোধী আন্দোলনের সময় ৮ই অক্টোবর রাতের অন্ধকারে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা শহীদ আবুল হাসেমকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রেললাইনের পাশে ফেলে রাখে।সে সময় তার ডিগ্রী পরীক্ষা চলছিল। চিহৃিত সন্ত্রাসী কর্তৃক আবুল হাশেমকে খুন করা হলেও তৎকালীন সময়ের সরকার ও প্রশাসন কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সংগঠন ও তার পরিবার থেকে মামলা করা হলেও এর কোন সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি।

Comments