রক্ষকই ভক্ষক

উম্মে আওয়ারা চাঁদনী

সভ্যতার সব রকম আদর্শহীন গ্রামের উদাহরণ দিতে হলে নাম উঠে আসবে পঞ্চগড় এর এই অজপাড়াগা “আলিপুর”।

খেটে খাওয়া কৃষিজীবী মানুষ গুলোর মন এখানের মাটির মতন ই নরম,বিশ্বাসী.দারিদ্য,হতাশা,আর্থিক কস্টে দিনানীপাত করে এরা।
একসময় আশার সূর্য উকি দিল-
গ্রাম চেয়ারম্যান এর মেঝ ছেলে জাহিদ,ইন্ডিয়ায় বড় ব্যাবসা করে। ৬ বছর পরে গ্রামে এসেছে,বাবা কে বলল-"ব্যাবসা তো করলাম বিদেশ এ,এইবার গ্রামের পোলাপান গুলারে নিয়া ব্যাবসা শুরু করুম। ব্যাবসা বেশি কিছু না ইন্ডিয়া থেকে বর্ডার ক্রস করে মাল আসবে,সেগুলো গ্রামে পৌছে দেওয়াই এক গ্রুপের কাজ হবে। আরেক গ্রুপ সেই মাল দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে দেবে.কাজ বুঝে কমিশন। "

কাজ না পাওয়া মাধ্যমিক পাস করা যুবক ছেলেদের কাজে আগ্রহের শেষ নেই,সবাই ই চায় সংসারের উন্নতির জন্য কিছু না কিছু করতে। ৩ জনের গ্রুপ ভাড়ায় ট্রাক নিয়ে ইন্ডিয়া বর্ডারের কাছে পৌছালো, দুজন গার্ড কে পয়সা দিয়ে ইন্ডিয়া বর্ডারে দাঁড়ানো ট্রাক থেকে বস্তা বস্তা মাল তুলল নিজেদের ট্রাকে। গ্রামে ট্রাক ঢুকিয়ে কাজ শেষ,পারিশ্রমিক নিয়ে হাসি মুখে বাড়ি ফেরে সবাই।

৫০ জন এর আরেক গ্রুপ জাহিদ ভাইয়ের গুদাম থেকে পূর্বে প্যাকিং করা মালামাল দেশের বিভিন্ন এজেন্ট এর হাতে নিজ দায়িত্বে পৌছিয়ে দেয়। এরা সবাই বিশ্বস্ত। শুধু গ্রামের শেষ প্রান্তে ছাপড়া দেয়া,বহু রক্ষিত গুদাম ঘরে বস্তা থেকে মালামাল ছোট প্যাকিং এর কাজ করে জাহিদ ভাইএর নিজস্ব লোকেরা।এরা ভাইয়ের সাথে একত্রে ইন্ডিয়ায় কাজ করেছে।

সবার চোখে জাহিদ ভাই এখন অন্নদাতা। নতুন নতুন ছেলেরাও আজকাল যোগ দিচ্ছে কারখানায়,এরা সবাই ই ইন্ডিয়ার পূর্ব পরিচিত জাহিদ ভাইএর।গ্রামের ছেলেরা শুধু আউটডোর এর কাজেই ব্যস্ত।তাতে কারো সমস্যা নাই,সবাই খেয়ে পরে ভাল আছে। ব্যাবসা ও আলহামদুলিল্লাহ ভাল ই চলছে। মাস দুয়েক এর মধ্যে গ্রামের সুন্দরি রাবেয়া কে ঘরেও তুলে নিলো সে।
আগামী নির্বাচনে বাবার বদলে জাহিদ ভাই ই দাড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জান দিয়ে হলেও জাহিদ ভাইককে জেতাতে কত ঐক্যবদ্ধ গ্রামবাসী! এমন লোক নেতা হবেনা তো কে হতে পারে আর! নির্বাচন উপলক্ষে দিন রাত লাগিয়ে খেটে যাচ্ছে প্রচার কর্মীগন।

পরশু নির্বাচন আজকে গ্রাম্য যুবক আজগর যাচ্ছে ২৫ প্যাকেট নিয়ে রাজধানী তে। বাস এ উঠার পর থেকেই একদল পুলিশ কেমন তাকে ফলো করে যাচ্ছে। সায়েদাবাদে এক ক্লাইন্ট কে মাল হাতে দেবার সময়েই আজগর কে গ্রেফতার করা হলো। প্যাকেটের ভেতরে ছিলো লাল ট্যাবলেট,যাকে নাকি ইয়াবা বলে-আজগররা যা কখনো দেখেওনি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ এর কবলে পড়ে আজগর কে বলতে হল জাহিদ ভাইয়ের কথা,এসব নেশাদ্রব্য নাকি তার ই ব্যাবসার হাতিয়ার। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেই দিনেই গ্রেপ্তার হয় আলিপুরের আরো লোক।

আজগর এর সহায়তায় জাহিদ পর্যন্ত পৌছালো পুলিশ। গ্রামের লোকেরা তাদের সহজ সরল চোখ দিয়ে ঘেরাও করা চেয়ারম্যান বাড়ি, গুদাম কারখানা,আর সবার অন্নদাতা জাহিদ কে দেখছে। কান যে চোখ কে বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হচ্ছে।  গুদাম থেকে বের হলো-লাল লাল লাখ লাখ পিস ট্যাবলেট,যা নাকি বিভিন্ন মানুষ নেশাসক্ত হতে ব্যবহার করেন!

জাহিদ ইন্ডিয়া তে চোরাচালানকারী ছিলো,বাংলাদেশি ইয়াবা এজেন্ট দের একজন।  সহজ সরল মানুষ গুলোর দারিদ্র‍্য হতাশা আর বিশ্বাস নিয়ে ব্যাবসা করেছেন এত দিন যাবৎ। সি আই ডি'র অনেকদিন এর গোপন তৎপরতায় আজকে তিনি ধরা পড়লেন।
দেশের মধ্যে পাচার কাজে লিপ্ত থাকা ইয়াবা এজেন্ট দের মধ্যে আলিপুরের ৫৫ জন যুবক গ্রেপ্তার দেখানো হলো।
রাবেয়া মুখে আচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেদে চলছে।চেয়ারম্যান মুর্ছিত হয়ে ঘরের মাঝে পড়ে আছেন। এত দিন এর সুখ,স্বপ্নের মৃত্যু,গ্রাম বাসীর ঘরেঘরে কান্নার ধ্বনি;অভাবের দরজায় কড়া নাড়া যেন শুনতে পাচ্ছে হতদরিদ্র‍্য পরিবারবর্গ।
এক দিক এ অন্ন যোগান বন্ধ,অপর দিকে সামর্থ্যবান লোকের অভাবে গ্রামটি যেন সন্ধ্যার আগেই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।

Comments