মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে

২১ জুলাই কর্ণেল আবু তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকী ।জুলাই মাস জুড়েই আমরা তাঁর কয়েকটি লেখা প্রকাশ করব ।আজ থাকছে  দ্বিতীয় পর্ব। লেখাটি এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সাময়িকী গ্রেনেড এ প্রকাশিত হয়েছিল।

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বারবার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তাময় সকালের মতো হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত হতে না পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর ইয়ুথ ক্যাম্পে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানচারচর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্ন; আর কতদিন অপেক্ষা করবো? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। রিক্রুটিং সেন্টারে লাইন দেখে আমি বুঝেছি, যোদ্ধারা জয়ী হবেই। কারণ পৃথিবীতে এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই।


গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দো-চীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারে পারেনি। ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযোদ্ধা তথা জনগণের এই বিজয়কে নিজের বলে মনে করে তা হবে সর্বৈব মিথ্যা।



পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ এত তীব্র ছিল যে, বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ হবার প্রখরতা অর্জন করেছিল। জাতীয় শোষণ থেকে মুক্তি পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এদেশের জনগণ তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছিল। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যোদ্ধা তরুণ সম্প্রদায়ের নিজস্ব। মুক্তিযুদ্ধ দানা বাঁধার মতো বাস্তব অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ২৫ মার্চের আগে বিদ্যমান থাকলেও সঠিক রাজনৈতিক দলের অভাব থাকার দরুন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। মার্চের প্রথম সপ্তাহেও মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়নি। যদিও শহুরে কিছু সংখ্যক বিপ্লবী তরুণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয় তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। 

২৫ মার্চের বর্বর আক্রমণ যদি পাকসেনারা না চালাতো তবে এ স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হতে আরও দেরী হতো বলেই আমার ধারণা। এ প্রতিরোধ সশস্ত্র হলেও সঙ্গে সঙ্গে তা মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়নি। এদেশের জনগণের কোন সামরিক অতীত ইতিহাস না থাকাতে এই প্রাথমিক অবস্থায় জনগণ অস্ত্র তুলে নেবার আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও সঙ্গে সঙ্গে তা পারেনি। তবে সামরিক ঐতিহ্য হীনতার এ অভাব জনগণ কয়েক মাসেই সাহসিকতার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছিল। মার্চ , এপ্রিল ও মে মাসে অল্প সংখ্যক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর (বর্তমান বি.ডি.আর) ও পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ এই নিয়মিত বাহিনীগুলোকে যুদ্ধের চিরাচরিত প্রথা ছেড়ে গেরিলা যুদ্ধের রীতিনীতির উপর শ্রদ্ধা আনতে কিছুটা সাহায্য করেছিল। আর ঠিক তখনই অর্থাৎ জুন মাসে এদেশে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা হয়। মুক্তিফৌজ গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চলে। জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধ একটা রূপ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে গ্রামে। আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণাঙ্গরুপ নেয় আর সেপ্টেম্বরে তা জোরদার হয়ে ওঠে।


এই কৃতিত্ব অর্জনের পর আমি মনে করেছিলাম আমরা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এমন একটা দৃষ্টান্ত রাখতে পারবো, যা নাকি এশিয়ার মুক্তিকামী জাতিসমূহকে জাতীয় মুক্তির প্রেরণা যোগাবে। বস্তুত, মুক্তিযোদ্ধারাই হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের উপর নির্ভর করেছিল আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা। যুদ্ধের অতীত ইতিহাস না থাকা সত্ত্বেও একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা ঘায়েল করতে পারে। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় উপাদান জনগণের আস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের তা ছিল। এটাকে বজায় রেখে রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক জীবনের সর্বত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তখন তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সে নেতৃত্ব নিতে বার্থ হয়। তবু নভেম্বর মাসের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব থাকা সত্ত্বেও সামরিক দিক থেকে অবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে এসে যায়। মূলত: পাক সেনারা তখন প্রতিটি অবস্থানেই ঘেরাও হয়ে পড়ে। চলমান শক্ররা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব, যা তাদেরকে জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত করে, গেরিলা যুদ্ধের প্রধান উপাদানকে বিকশিত করতো, তা না থাকায় গুণগত দিক থেকে সার্বিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণাত্মক বিকাশ ঘটতে থাকে। ঐ সময়েই আমি এই সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করি।

তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, রণনীতির এ সমস্যা মূলত: জনগণের সঙ্গে সৈনিকদের সম্পর্কের সমস্যা। কাজেই এ সমস্যা সমাধান করতে হলে জনগণের সঙ্গে সৈনিকদের সম্পর্ক কে নির্ণয় করতে হবে। দুঃখজনক ভাবে তখনই নিয়মিত ও অধিকাংশ গেরিলা সৈনিক মনে করতেন - যেহেতু তারা যুদ্ধ করছেন, সেহেতু জনগণ তাদের সাহায্য করবে। এই মানসিকতাই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ঋণাত্মক বিকাশের জন্য দায়ী ছিল। যুদ্ধরত নিয়মিত সৈনিকেরা এ সত্যকে কোন দিনই অনুধাবন করতে পারেনি। আর তাদের বোঝতে পারাটাও সম্ভব ছিলনা। তাদের ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাও এ সমস্যাকে প্রাথমিক অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারেনি। তবুও গেরিলা যোদ্ধাদের মাঝে অক্টোবর মাস থেকেই এ সমস্যাকে স্বীকার করে নেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি যা নভেম্বর মাসে রীতিমত একটি সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু এটা ছিল বিকল্প। যে সমস্যার সমাধান করবে রাজনৈতিক বিভাগ, তাকে সামরিক বিভাগ বাধ্য হয়ে কার্যক্রমের আওতায় ফেললো। নিয়মিত সৈনিকদের কোন আদর্শগত ভিত্তি না থাকায় তারা কোনদিনই জনযুদ্ধকে রূপ দিতে পারতো না। তারা ছিল অবস্থার শিকার। ফলে প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এ সমস্যার সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এই সময় আমি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে সুষ্পষ্ঠ রূপ দিতে আহবান জানাই। এ যুদ্ধ ছিল উপনিবেশিক পাকিস্তানীদের সঙ্গে জনগণের যুদ্ধ। জনগণ তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করেছে। শুধু যুদ্ধ করলেই জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হয়। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ - জনগণের যুদ্ধ। যুদ্ধও জনগণের জীবনের একটি অঙ্গ। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, প্রশাসন , ধর্ম ইত্যাদি যেমন তার জীবনের অঙ্গ । তাই তখন ১১ নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের বলতাম, "কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগী খেয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। যদি কোন কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও, সকালে গোবরটা পরিষ্কার কোরো। যে দিন অপারেশন না থকে তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা Deep Trench Latreen তৈরী করে দিও। তাদের সঙ্গে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও।"


এগুলো হলো জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হবার পদ্ধতি। এটাকে রপ্ত করা, শিক্ষা দেয়া ও প্রয়োগ করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের, যারা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটকে এ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক শিক্ষার, যারা গেরিলা যুদ্ধের অভিধানে রাজনৈতিক উপদেষ্টা নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের "ভাড়াটে সৈনিক" হিসাবে গন্য করলো। এ সময়ে আমি আমার সেক্টরে রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য কিছু সংখ্যক সচেতন অধ্যাপককে "অপারেশন অফিসার" হিসাবে নিয়োগ করি। এতে বিশেষ সুফল পাওয়া গিয়েছিল। সমগ্র বাংলাদেশে গেরিলারা কোন একক কমান্ডের অধীন ছিল না। মূলতঃ সামরিক নেতৃত্বে ছিল কেন্দ্রীকতার অভাব আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল সামরিক ব্যুৎপত্তির অভাব। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদিকে ছিল দুর্বল, অপরদিকে অসমন্বিত। সামরিক নেতৃত্বের রাজনীতি করণ মোটেও হয়নি।


ঠিক ক্রান্তিলগ্নে এলো ১৬ ডিসেম্বর

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর ছিল দেউলিয়া রাজনীতির অধৈর্যতার ফল। তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা তখন সশস্ত্র চরম শক্তির অধিকারী। কিন্তু নেতৃত্বের শূন্যতায় কখন যে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার হাত বদল হয়ে গেলো তা মুক্তিযোদ্ধারা উপলব্ধি করতে পারলো না। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন , সরল প্রাণ বাংলার মানুষও বুঝতে পারলো না যে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃতরুপে নিশ্চল করে দেয়া হয়েছে। জয়ী হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা হেরে গেছে।



মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করা হলো। তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিকভাবেই ভাবলো নেতৃত্ব তাদেরই হাতে। ভাবলো তাদের কৃতিত্বের জন্য জনগণ তাদেরকে চিরদিন সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসিয়ে রাখবে। এদিকে জনজীবনে নেমে এলো চরম দুর্দশা। অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সার্বিক অধঃপতনে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠলো। এ অধঃপতনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ী হয়ে পড়লো জনগণের কাছে। চরম নৈরাশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গু করে দিল; জাগ্রত হল অপরাধবোধ। নৈতিক অধঃপতন ঘটলো তরুণ সমাজের। এক অশুভ শক্তি মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের প্রভেদ রেখা ক্রমে মুছে দিতে শুরু করলো । মুক্তিযোদ্ধারা হলো হীন ষড়যন্ত্রের শিকার।


মুক্তিযুদ্ধে সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে মানুষের মধ্যে আসে দেশ গড়ার উদ্যম ও উদ্দীপনার জোয়ার। সেই উদ্যম ও উদ্দীপনার জোয়ার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি লক্ষ্য করেছি বাংলার মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু যে ষড়যন্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গু করে দিয়েছে সেই ষড়যন্ত্র দেশ গড়ার উদ্যমকে বার্থ করে দিল। অপর দিকে জনগণ এটাকে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতকর্মের ফল ভেবে ভুল করলো। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা এনেছে সামরিক বিজয়। জনগণ এদের নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্ব হারিয়েও জনগণের মনে নেতৃত্বের আসনে বসে আছে। সে জন্য তারা তাদের সমস্ত দুর্গতির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করলো। কারণ তারা জনগণের নিজস্ব লোক। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতৃত্বের আইনানুগ উত্তরাধিকার।

বাংলার দুর্ভাগ্য, আইনানুগ উত্তরাধিকারের বদলে সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে, যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরানো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে দাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চ পদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ধরে সোপর্দ করেছে পাকিস্তানীদের হাতে, তিনিই আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরী করেছে রাজাকার বাহিনী, তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চাকুরী দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেননি, তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেওয়ার বাহানা করছেন। যে ব্যবসায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধকালে চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন, তিনি এখন মনে করেন জনগণকে ঠকানো তার জন্মগত অধিকার। মুক্তিযোদ্ধাদের তাই লাইসেন্স, পারমিট দেয়া চলবে না। পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরী করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ, মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে দেশে তৈরী করা হয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে। যাতে করে বিপ্লবী জনতার অংশ হতে না পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারাই সর্বস্তরে নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে।

আজ ষড়যন্ত্রের প্রচার বিভাগের মাইক্রোফোন হয়ে দাড়িয়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীরা। এরা চরিত্রগতভাবে দুমুখো, সুবিধাবাদী ও দোদুল্যমান। ২৫শে মার্চের আগে এরা স্বাধীনতার বড় মিত্র ছিল। এরা ভেবেছিল অবাঙ্গালী ও পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হয়ে পুঁজির বিকাশ ও চাকুরীসহ সর্বক্ষেত্রে তারা সুবিধা পাবে। ২৫ মার্চেও পর যখন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হলো তখন রাতারাতি তারা হয়ে উঠলেন পাকিস্তান পছন্দ। পাক সেনাদের পথ দেখানো আর সাহস যোগানো তাদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠলো। স্বাধীনতার পর এরা আবার দেশপ্রেমিক হলেন। আজ জনগণের চরম দুর্যোগ, বিদ্বেষ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির অপচেষ্টা করাই হচ্ছে তাদের একান্ত কর্তব্য। এরা বিশ্বাসঘাতক, সর্বযুগে সর্বক্ষেত্রের দেশদ্রোহীরা দেশমাতা'র অযোগ্য সন্তান। এরা বাংলার সরল জনগণের মাথার বোঝা। এই বোঝাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। নির্মূল করতে হবে এদেরকে। যাতে বাংলাদেশে আর বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি না হয়।

Comments