কার্ল মার্কস— নতুন পৃথিবীর দিশারী


শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

কার্ল মার্কস বিগত দেড়শত বছরেরও বেশি কাল পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব। শোষণ, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে যারা এই পৃথিবীর বুকেই স্বর্গ রচনার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, অনুপ্রেরণার উৎস হলেন কার্ল মার্কস ও তাঁর শিক্ষা। বিপরীতে, দুনিয়ার সমস্ত শোষকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কার্ল মার্কস ও মার্কসবাদ। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বিগত প্রায় দেড়শত বছর ধরে সমগ্র পৃথিবীকে সর্বাধিক আলোকিত করেছে মার্কসবাদ।
১৮১৮ সালের ৫ই মে প্রুশিয়ার ট্রিয়ের শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

প্রকৃতি জগত হলো বস্তুময়। বস্তু কখনও স্থির থাকে না। নিরন্তর গতির মধ্যে অবস্থান করছে প্রতিটি বস্তু ও সমগ্র বস্তুজগৎ। বস্তু কথার অর্থ ব্যাপক। বস্তু, শক্তি, ঘটনা সমস্ত কিছুই বস্তুজগতের অন্তর্গত। গতির ফলেই বস্তুর রূপের পরিবর্তন ঘটছে। এভাবেই অচেতন পদার্থ থেকে চেতন পদার্থ তথা চেতনার আবির্ভাব ঘটে। ভাব বা চেতনা বস্তুর বিকা‍‌শের ধারায় উদ্ভূত। বস্তুর গতি ও পরিবর্তনের কারণ ও বিকাশধারাকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত করলো মার্কসীয় দর্শন।
অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো অর্থশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এর ওপর দাঁড়িয়েই মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসীয় অর্থনীতি গড়ে তুললেন। মূল্যের শ্রমতত্ত্ব পূর্বসূরি দিকপাল অর্থনীতিবিদরা আবিষ্কার করলেও উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব পুরোপুরিভাবে মার্কসেরই আবিষ্কার। শ্রমের মূল্য ও শ্রমশক্তির মূল্যের ‍‌ফারাকই হলো উদ্বৃত্তমূল্য। এটাই তো মার্কসীয় অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি ও আত্মসাৎই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু। পুঁজির সৃ‍‌ষ্টি ও বৃদ্ধিই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার মূল কারণ। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদ অগ্রসর হয়।
মার্কসীয় অর্থনীতির আ‍‌লোচনায় দেখানো হলো যে, সামাজিক উৎপাদন ও ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্বই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমস্ত সঙ্কটের মূল কারণ। এই দ্বন্দ্বের সমাধান একমাত্র সম্ভব উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এইভাবে মার্কসীয় অর্থনীতি সামাজিক বিপ্লবের প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো।

উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ধারাতেই সমাজ শ্রেণীতে বিভক্ত হলো। মানব সমাজে শ্রেণীর আবির্ভাবের পর থেকে মানব সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। দাস সমাজই ছি‍‌লো প্রথম শ্রেণী বিভক্ত সমাজ। ক্রমান্বয়ে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটেছে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণীশোষণ নগ্নতম এবং শ্রেণীসংগ্রাম সরলতর হয়েছে। পুঁজিপতি শ্রেণীর মুখোমুখি শ্রমিকশ্রেণী। আধুনিক শিল্পের সৃষ্টি সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী। এই শ্রেণীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্যই উৎপাদনের উপায়ের ওপর সমস্ত ধরনের মালিকানার অবসান ঘটাতে হবে। অর্থাৎ শোষণের ভিত্তিটার অবসান ঘটাতে হবে। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত শ্রেণী সংগ্রাম পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক রূপ সর্বহারার একনায়কত্ব। এই একনায়কত্বর লক্ষ্য হলো শোষণহীন, শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ। পুঁজিবাদ থেকে সমাজত‍‌ন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব বিপ্লবের মাধ্যমে। সর্বহারার নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রাম সফল করার জন্য তার নিজস্ব পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার বিষয়টিও খুব গুরুত্ব দিয়ে মার্কস-এঙ্গেলস আলোচনা করেন।
মার্কসবাদ আজ আরও প্রাসঙ্গিক
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ ও শোষণ ব্যবস্থা বিরাজ করছে। পুঁজিবাদী শোষণের নির্মমতা, বর্বরতা সকলের চোখের সামনে। যে পুঁজিতে আধিপত্য হলো পুঁজিবাদের মর্মবস্তু, সেই পুঁজির আবির্ভাব ঘটে যখন তখন তার সমগ্র দেহ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। পুঁজিবাদ, তার নির্মম শোষণ ও চক্রাকারে সঙ্কট এবং সঙ্কটের তীব্রতা বৃদ্ধি মার্কসবাদকে বর্তমান সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।

পুঁজিবাদের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য

মানব সমাজের অগ্রগতির ধারায় পুঁজিবাদের পতন ঘটে সমাজতন্ত্র কায়েম হবেই। মানব সমাজ সাম্যবাদের দিকে এগিয়ে যাবেই। এটা অবধারিত। মার্কসীয় মতবাদ হলো বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞানই আমাদের শিখিয়েছে যে, সমাজের এই বৈপ্লবিক রূপান্তর সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমস্ত শোষিত-বঞ্চিত মানুষের সম্মিলিত বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। দেশে দেশে পরিচালিত হবে এই বিপ্লবী সংগ্রাম।

[সংকলিত লেখা]

Comments