নুসরাত জাহান মীম
একটা সময় ছিল, যখন ভাবা হত মৃত স্বামীর সাথে চিতায় পুড়লে আত্মা স্বর্গবাস পায়, একটা সময় ছিল, যখন ভাবা হত কন্যাসন্তান জন্মদান মানে পিতা দায়গ্রস্ত। একটা সময় ছিল, যখন ভাবা হত কৃষ্ণকায় প্রেমিকা মানে বধূ হবার অযোগ্যতা। এগুলো সবই একটা সময় ছিল। খুবই ভালো হত যদি এগুলো সবই 'একটা সময়ে ছিল' হত। আজ আমরা সবাই একটা সময় পেরিয়ে বহু অগ্রসর। কিন্তু সবচেয়ে দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কালের পরিক্রমায় সতীদাহ প্রথা, গৌরীদানের মত প্রথা ভেঙে নারীদের যে সুপথে অগ্রসর হবার কথা, সেখানে আজও তাঁরা "ক্ষণিকের সংরক্ষণশীলতার নীতি'-র মত ঘুরেফিরে সেই দুর্বলতায় আটকে রয়েছে।
নারী হচ্ছেন তিনি যিনি সৃষ্টিকে ধারণ করেন। যার মধ্যে বিকশিত হয় ধরিত্রী। নারী বোবা বাক্স নয়। নারী আজ শিক্ষায় অগ্রসর, ক্ষমতায় অগ্রসর অর্থনীতিতে আজ ভূমিকা রাখছে। একটা সময়ে আমরা নারীদের যেমন অত্যাচারিত হতে দেখেছি, তা থেকে ইলা মিত্র, প্রীতিলতা, লক্ষ্মীবাঈ, বেগম রোকেয়া, কুসুমকুমারী দেবী, কামিনী রায়, প্রমুখ তাঁদের অসীম সাহস ও উদ্যম দিয়ে আজকের নারীকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তাঁরা নিঃসন্দেহে সেলুলয়েড। তাঁদের প্রেরণায় এবং কালের পরিক্রমায় নারী আজ উন্নত, তবে সুশিক্ষার প্রয়োগে নয়, শুধুমাত্র শিলনোড়া থেকে মিক্সার গ্রাইণ্ডারে। নারী আজও ভাবে সে শুধুমাত্র পিতার লক্ষ্মী কিংবা স্বরসতী। সে কোনভাবেই দূর্গা কিংবা শ্যামা হওয়ার প্রেরণা পায়না । সে আজও স্বামীর দাস, কারণ স্বামী ছাড়া তাঁর সমাজে স্থান 'পতিতার'। নারী নিজেকে কোনভাবেই সম্পূর্ণ করতে পারেনা। নারী আজও ধর্ষিত হয়। একটা সময় শুধুমাত্র তা হেরেমের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা সভ্যতার ছোঁয়া লেগে চার কিংবা আট পাতার সংবাদপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ বলতে হলো কারণ, ধর্ষণ বাড়ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় কমছেনা। ধর্ষণের কারণ হিসেবে নারীকেই দায়ী করা হয়। যে শোষিত সেই গ্রহণ করতে বাধ্য হয় সমস্ত নিগৃহ। এর মূল কারণ নারী নিজেই। কারণ সে তাঁর সম্পর্কে অচেতন। নারী মিক্সার গ্রাইণ্ডার চালানোর পাশাপাশি হেলিকপ্টারের পাখা ঘোরানোর স্বপ্নও দেখুক। আর সে স্বপ্ন পূরণে সে প্রয়োজনীয় সকল শিক্ষা গ্রহণ করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক, অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হোক।
আসছে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। এইদিন নারীদের অধিকার আদায়ের দিন। ১৯১৭ সালের এইদিনে সোভিয়েত রাশিয়ায় নারীরা ধর্মঘট পালন করেছিল অধিকার আদায়ের দাবীতে। এর চারদিন পরে সেখানে পৃথিবীতে প্রথমবারের মত নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
নারী, নারী দিবসকে শুধু দিবস হিসেবে পালন না করে সেদিন হতে নিজেকে গর্বভরে নারী ভাবতে শিখুক। যে মূলমন্ত্র নিয়ে দিবসটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তা নারী পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুক। নারী সর্বপ্রথমে নিজেকে জানুক, ভালবাসুক, প্রতিষ্ঠা করুক। নারী বিমান ওড়াক, আটপৌরে শাড়িও পরুক, নারী কারাতে শিখুক, হাত তুলে মোনাজাতও ধরুক, নারী সার্টিফিকেট আনুক, সেলাই মেশিনও ঘোরাক। যেদিন নারী নিজেকে নিজে সম্মান দিতে শিখবে, সেদিন নারী সম্মানিত হবে নিজ গৌরবে। প্রতিটি নারী ব্লেজার পরে প্রেজেন্টেশনে সেরা হওয়ার পাশাপাশি শাড়ির আঁচলে তাঁর সন্তানকে সুশিক্ষিত করুক। নারী ভালো যেমন বাসে, তেমনি সম্মান এর সাথে ভালবাসাও পাক।
ভাল থাকুক 'নারী'।
লেখিকা : কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বরিশাল জেলা সংসদ।
![]() |
| ১৯১৭ সালে রাশিয়ার পেট্রোগ্রাদে নারীদের ধর্মঘট |

Comments
Post a Comment