আ-মরি বাংলা ভাষা


একটি জাতির সত্তা তার ভাষার মধ্যে নিহিত। ভাষার সাহায্যে - তার প্রত্যয়ে কথা, নিঃশ্বাসের কথা সর্বোপরি অর্ন্তলীন ভাবাবেগকে প্রকাশ করে  তাই ভাষা যদি নিরুদ্ধ হয় তাহলে একটি জাতি তার আত্মবিকাশের পথ খুঁজে পায়না। জাতি এবং ভাষা উভয় সত্তা একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই বলা যায় আত্মবিকাশের প্রয়াসে নদীর স্রোতের মত নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে বহমান।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বিক্ষোভ

আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ভারতে হিন্দু শাসনামলে সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতদের পাশ কেটে সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন থেকে বের হয়ে এসেছিল যে ভাষাস্রোত তা থেকেই বাংলা ভাষার অঙ্কুরোদগম। চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। দ্বাদশ শতাব্দী বাংলা ভাষার মধ্যযুগ। বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, ও মুসলমান কবিদের রচিত।

মূল্যায়নের জন্য আমাদের বাংলা ভাষা সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পার করেছে। দু'শ বছর ব্রিটিশ শাসন করার পর সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সালাম, বরকত, জব্বার প্রমুখ অকুতোভয় যুবক আত্মাহুতি দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার আসনে আসীন করেন। কালের বিবর্তনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঘটনা স্বাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাড়িয়ে আছে আজকের শহীদ মিনার। আমাদের দেশের ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বার্থান্বেষী মানুষের পতন, '৬৯ সালের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় - সব ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই এসেছে।

আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আধিপত্য বিস্তারকারী বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে জয়যুক্ত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আজও অব্যাহত। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন্রর আত্মদানকৃত শহীদদের রক্তকে উপেক্ষা করে আজ রাষ্ট্রীয় সকল কাজে ইংরেজি ভাষার প্রচলন হচ্ছে। কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইংরেজ মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চৌকস করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করছে। সেখানে বাংলা ভাষার গুরুত্ব উপেক্ষিত। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমাদের মুক্ত বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করলেও আমাদের অন্ধকার দূর করতে পারেনি। কিন্তু বাংলা ভাষায় যদি এই জ্ঞান অর্জন করা যায় তবে তা আধুনিক মুক্ত বুদ্ধিতে রূপ নেবে। বাংলা ভাষার প্রতি এমন উপেক্ষা তথা অবজ্ঞা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা স্মরণ রেখেই বিদেশি ভাষার অনাবশ্যক মোহ কাটিয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ


বাঙালী পৃথিবীতে প্রথম জাতি যে জাতি তার মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে। তাই নতুন সহস্রাব্দে এসে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিশ্ব দরবারে এ স্বীকৃতি আমাদের পরম ও চরম গৌরবের। সারা পৃথিবীর নানান ভাষাভাষীর মানুষ এ দিবসটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করবে, আগ্রহ এবং সম্মান দেখাবে। আমাদের এ বিরাট প্রাপ্তিতে বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সম্মানজনক আসনে আসী  দেখে আমরা আবেগাপ্লুত এবং তাই কবির ভাষায় উদীপ্ত হয়ে বলতে পারি - 'মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা। ' ∆

জান্নাতুল ফেরদৌস
বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ,
বাংলা বিভাগ
(প্রাক্তন  শিক্ষার্থী, সরকারি বরিশাল কলেজ)

Comments